পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা ও এ হামলার পর তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতারা যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। এগুলো হলো, পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য এ হামলা ও তাদের বক্তব্য কী বার্তা দিচ্ছে এবং এ ঘটনা দেশটিকে কোন দিকে নিচ্ছে।
ইমরান খানের ওপর হামলার পর বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে ডন-এর কথা হয়েছে। অধিকাংশ বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন, রাজনীতির মাধ্যমে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তারই ফলাফল মনে হয়েছে এ হামলা। কয়েক বছর ধরে এই বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে।
বিশেষ করে, গত এপ্রিলে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এই বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা আরও বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে। এ ছাড়া এর কারণে সামাজিক বন্ধন আরও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলেও অভিমত দিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়া সেন্টার অব দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো সুজা নাওয়াজের মতে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। তারা একে অপরের অতীত নিয়ে কাদা-ছোড়াছুড়ি করছে। এরই মধ্যে ইমরানের ওপর হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে ফেলবে।
তিনি বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তার স্বচ্ছ তদন্ত হতে হবে। প্রথমে পাঞ্জাব সরকারকে এ ঘটনা তদন্ত করতে হবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ঘটনার তদন্ত করতে হবে। এই ঘটনায় যে অস্ত্র ও বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, তার ফরেনসিক পরীক্ষা করতে হবে। এটা না করা হলে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়বে এবং যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
ইমরান খানের ওপর হামলার কারণে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তান সেরাইকি পার্টির চেয়ারপারসন ও শিক্ষাবিদ নুখবাহ তাজ লানগাহ। তিনিও সুজা নাওয়াজের বক্তব্যের সঙ্গে একমত। নুখবাহ তাজ বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই জটিল। দেশটির রাজনীতি ইতিমধ্যে ঘৃণার কারণে বিভক্ত। এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
গত এক মাসে দুজন সাংবাদিক মারা গেছেন। এর মধ্যে একজন প্রাণ হারিয়েছেন পাকিস্তানে ইমরানের লংমার্চের কনটেইনার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে। আরেকজন মারা গেছেন কেনিয়ায়। এরই মধ্যে পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে একজন জাতীয় নেতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটল। এ প্রসঙ্গে নুখবাহ তাজ বলেন, এখানে মানুষের জীবনের দাম কমে গেছে। এই দাম আরও কমবে, যদি না রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সংকটের সমাধান হয়।
বিশ্লেষকদের বক্তব্যের সঙ্গে পিটিআইয়ের নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর বক্তব্যও মিলে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ওই হামলার পর তিনি বলেছিলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা। দলের নেতা-কর্মীদের উচিত এখন রাস্তায় নেমে আসা এবং প্রতিশোধ নেওয়া। পাকিস্তানজুড়েই এ ঘটনা ঘটা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ফাওয়াদ চৌধুরীর এ বক্তব্যের পর ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের আগুনে ঘি ঢেলেছেন পিটিআইয়ের মহাসচিব আসাদ ওমর। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ইমরান খান এখন ঝুঁকিমুক্ত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বার্তা দিয়েছেন, ‘আমার কাছে হামলার বিষয়ে তথ্য আছে। আমি সন্দেহভাজনদের চিনি।’
ইমরান খানকে উদ্ধৃত করে এই হামলার জন্য তিনজনকে দায়ী করেছেন আসাদ ওমর। এই তিনজন সরকারি ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা। পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ এড়াতে এ তিনজনকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়েছেন পিটিআই মহাসচিব। এসব ঘটনার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পাঞ্জাবের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী হাসান আসকারি রিজভি।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকরাম সেহগাল। তিনি বলেন, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কেউ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে যান না। হতে পারে, কাউকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু যা-ই হোক আর যেটাই হোক, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশ শুধু একটি দিকেই এগিয়ে যাবে। আর সেটা হলো, আরও রাজনৈতিক সংকট, আরও ঘৃণা, আরও সহিংসতা। আর জীবনে জন্য ঝুঁকির হলেও রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনা ইমরান খানকে সাহায্য করতে পারে। এর মাধ্যমে দোদুল্যমান ভোটাররা তার পক্ষে যেতে পারেন।
হামলায় কি সেনাবাহিনী জড়িত?
লংমার্চে সশস্ত্র হামলার শিকার হওয়ার এক দিন পর গতকাল শুক্রবার মুখ খুলেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তার ওপর হামলার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ে কর্মরত মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরকে দায়ী করেছেন তিনি। এ ছাড়া সুস্থ হয়ে আবারও আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন ইমরান খান।
শাহবাজ সরকারকে আক্রমণ করে ইমরান খান বলেন, ‘আমি পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসন দেখেছি। সেই সময় আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের শাসনের চেয়ে আজকের শাসন ভয়ংকর।’
তাকে হত্যার পরিকল্পনার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে ইমরান খান বলেন, ‘আমি সাড়ে তিন বছর সরকারে ছিলাম। আমাকে পছন্দ করেন, এমন অনেকে এখনো সরকারি চাকরি করেন। অনেকে গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করেন। তারা হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছেন।’
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আমাকে হত্যার জন্য আগেই পরিকল্পনা করেছিল। আমাকে হত্যার জন্য চারজন মিলে বৈঠক করেছিল। আমাকে হত্যার আশঙ্কার কথা জানিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে বলেছিলাম।’ এরপর ২৪ সেপ্টেম্বরের সেই সমাবেশের ভিডিও প্রচার করা হয়।
ইমরান খান বলেন, ‘২৪ সেপ্টেম্বর আমি যে চারজনের হামলার পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম, ওয়াজিরাবাদে হামলায় তার মিল নেই। এই চারজন কিন্তু ওয়াজিরাবাদের হামলার সঙ্গে জড়িত তিনজন থেকে আলাদা।’
ওয়াজিরাবাদের হামলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ ও আইএসআইয়ে কর্মরত মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরকে দায়ী করেন করে ইমরান বলেন, রানা সানাউল্লাহ অর্থের জন্য যা ইচ্ছা তাই করতেন পারেন। শাহবাজ শরিফের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
এ ঘটনার বিচার চেয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার উদ্দেশে ইমরান খান বলেন, সেনাবাহিনী কি আইনের ঊর্ধ্বে? সেনাবাহিনীতে এমন অনেকে বসে আছেন, যাঁরা সাধারণ মানুষকে গরু–ছাগল ভাবতে শুরু করেছেন। মেজর জেনারেল ফয়সালের কি বিচার হবে?
এসডব্লিউএসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ