ঘোরতর সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সামনে শ্রীলঙ্কানদের কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এখনই আন্দাজ করা মুশকিল। এমন সময় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা চীনের বর্তমান অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী রাজাপক্ষে পরিবারকে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হতো। যখন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, তখন চীনের অর্থায়নে বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলা হয় দেশটিতে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। বিতর্কিত ঋণের অংশ হিসেবে ৯৯ বছরের চুক্তির অধীনে একটি চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে সমুদ্রবন্দরটি ইজারা দেওয়া হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। এরপর দেশটির রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে রাজাপক্ষে পরিবার। এ পরিবারের সদস্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট—দুই পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশটির সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট। আরেক ভাই বাসিল রাজাপক্ষে ছিলেন অর্থমন্ত্রী।
শ্রীলঙ্কা ছেড়ে পালিয়ে মালদ্বীপ হয়ে সিঙ্গাপুর গেছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন। তার নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরই দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর রাজধানী কলম্বো ও আশপাশের এলাকায় কারফিউ জারি হয়েছে।
এদিকে, ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় সমস্যা বা সংকটের সমাধান কীভাবে হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। দেশটিতে কী ঘটতে পারে, আছে সেটা নিয়েও আলোচনা।
সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সময় চীনের নীরব থাকা নিয়ে হচ্ছে আলোচনা। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে দেশটির দহরম–মহরম ও নানা প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণেই এ আলোচনা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করেন, চীনের অব্যাহত ঋণের কারণে শ্রীলঙ্কা ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে থাকা চীনকে নিয়ে আলোচনা বেশি। এদিকে, কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সময় শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তার কথা বিবেচনা করছে কি না, সে বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থাকে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন। শ্রীলঙ্কা নিয়ে চীনের অবস্থান এখন কেমন, কী বলছে দেশটি, তা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম দ্য হিন্দু একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে।
আনান্থ কৃষ্ণাণ-এর সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের সাম্প্রতিক ঋণ সমস্যার জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করছে চীন। শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তার কথা বিবেচনা করছে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটি।
বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, একটি বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী এবং সহযোগী অংশীদার হিসেবে আন্তরিকভাবে চীন আশা করে, শ্রীলঙ্কাকা সব খাতে দেশের ও মানুষের মৌলিক একটি স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে হবে, সেই জটিলতাকে কাটিয়ে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হবে। সবার আগে এসব করতে হবে।
এ সময় ওয়াং ওয়েনবিনের কাছে দ্য হিন্দুর সাংবাদিক জানতে চান, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সহায়তার আহ্বানের বিষয় চীন বিবেচনা করছে কি না এবং এ নিয়ে কোনো আলোচনা চলছে কি না? এর উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান ওয়াং ওয়েনবিন। তিনি বলেন, চীন শ্রীলঙ্কায় একটি টেকসই উন্নতি এবং বর্তমান জটিল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কলম্বোতে যে সরকারই আসুক না কেন তার সঙ্গে কাজ করার মতো বৃহত্তর অবস্থায় আছে বেইজিং। যেটা তারা করেছে পূর্ববর্তী সিরিসেনা সরকারের সময়েও।
তবু শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ ও সহায়তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে চীন। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে ‘ঋণের ফাঁদ’ সৃষ্টির অভিযোগ আছে। এ সপ্তাহে এক হিসাবে দেখা গেছে জাপান যে ঋণ দিয়েছে তার তুলনায় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ ঋণ দিয়েছে চীন। বেশির ভাগ ঋণ দেওয়া হয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে।
এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সাম্প্রতিক ঋণ সমস্যার জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করেছে চীন। ওয়াং ওয়েনবিন বৃহস্পতিবার ডেব্ট জাস্টিস গ্রুপের নতুন এক প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে দেখিয়েছেন, ৪৯টি আফ্রিকা দেশের সরকারের ৬৯৬ বিলিয়ন ঋণের মধ্যে ৩৫ শতাংশ চীনের বাইরের ঋণদাতাদের এবং মাত্র ১২ চীনের। তিনি বলেন, এ তথ্যগুলোই প্রমাণ করে তথাকথিত চীন ঋণের ফাঁদ বলে পশ্চিমারা আফ্রিকার সংকটের জন্য চীনকে দায়ী করে যা বলে, তা বিভ্রান্তির বক্তব্য।
চীনের সরকারি গণমাধ্যম চায়না ডেইলি শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, ‘কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ভ্রান্ত উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য চীনকে দায়ী করার চেষ্টা করে চলেছেন। জাপান ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পর শ্রীলঙ্কার ঋণদাতাদের মধ্যে চীন তৃতীয় স্থানে। আর চীনের ঋণের পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ।
গণমাধ্যমটি গোতাবায়া রাজাপক্ষ সরকারের সমালোচনা করে বলেছে, তার ত্রুটিপূর্ণ নীতি ‘দুর্ভোগ বাড়িয়েছে’ দেশটিতে। কর কমানো এবং সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা বা গণমাধ্যম রাজাপক্ষদের কোনো সমর্থন দেয়নি।
এদিকে, কিছু বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কলম্বোয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ‘বড় প্রভাব’ ফেলবে। তাঁরা এই পরিস্থিতিকে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্যও বার্তা বলে মনে করছেন।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বিনিথা রেভি। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থায় চীন বিচ্ছিন্ন থাকতে ইচ্ছুক এবং অপেক্ষা করে পরিস্থিতি দেখে মন্তব্য করার নীতিতে আছে। ভারত ও চীন উভয়ই শ্রীলঙ্কায় (বর্তমান পরিস্থিতি) ঘটনা ঘটতে দিচ্ছিল। শ্রীলঙ্কা নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন খেলাও ছিল।
ইতিহাস, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখে এ ক্ষেত্রে ভারতকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। চীন আবার আরও বাস্তববাদী। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তারা খুব দ্রুত সেখানে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। চীনা বিনিয়োগকে না বলা যেকোনো সরকারের পক্ষেই কঠিন হয়।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, ‘স্বল্প মেয়াদে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের সম্পর্কে বড় প্রভাব পড়বে। কারণ, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বৃত্তে রাজাপক্ষে পরিবারের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন অসম্ভাব্য হবে।
লিন আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ ঋণ এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট শ্রীলঙ্কার এ সংকট চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘সতর্ক বার্তা’। এসব বিনিয়োগকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন, যেসব দেশ জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, খাদ্যঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান মার্কিন সুদের জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
ওই বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে লিন আরও বলেন, ‘আমি একে উচিত শিক্ষা পাওয়া বলব না। তবে একে বলব সকর্তবার্তা। কারণ, বিদেশে বিনিয়োগ করার সময় স্থানীয় প্রশাসনের দক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যখন সামগ্রিক আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনূকূলে নয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঋণের অনুপাত সাধারণত খুব বেশি।’
সাংহাইয়ের এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শ্রীলঙ্কায় চীনের যে বিনিয়োগ, তার জন্য কিছু লোকসান গুনতে হতে পারে। আর তাই হয়তো নিজের অবস্থান এখনই খোলাসা করতে চাইছে না চীন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ