নতুন করে প্রাপ্ত কিছু সামরিক নথিপত্র অনুযায়ী ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর বিশেষ ইউনিট স্পেশাল এয়ার সার্ভিসেস বা এসএএস বাহিনীর একটি ইউনিট ছয় মাসে অবৈধভাবে ৫৪জনকে হত্যা করেছে আফগানিস্তানে।
বিবিসি এক তদন্তে জানতে পেরেছে বেশ সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে বন্দি এবং বেসামরিক নাগরিকদের একের পর এক হত্যা করা হয়েছে।
এসএএস বিশেষ বাহিনীটির সাবেক প্রধান, জেনারেল স্যার মার্ক কার্লটন-স্মিথ এই অভিযোগের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ২০১৮ সালে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। মাত্র গত মাসেই তিনি তার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
তাকে সেসময় জানানো হলেও তিনি রয়াল মিলিটারি পুলিশকে সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেননি। এমনকি রয়াল মিলিটারি পুলিশ এসএএস ইউনিটের বিরুদ্ধে একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করার পরও তিনি তথ্য দেননি।
উল্টো ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে ব্রিটিশ সৈন্যরা “আফগানিস্তানে সাহস ও পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করেছে”।
হত্যার প্রতিযোগিতা
২০১০ ও ২০১১ সালে আফগানিস্তানের হেলমান্দে এসএএস স্কোয়াড্রনের “কিল অর ক্যাপচার” বা “হত্যা অথবা আটক” অভিযান সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও শতশত পৃষ্ঠার নথিপত্র পর্যালোচনা করেছে বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠান।
ওই সময় হেলমান্দে বিশেষ ইউনিটের সাথে কর্মরত ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে এসএএস সেনারা রাতের অভিযানে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। হত্যার পক্ষে যুক্তি তৈরি করার জন্য ঘটনাস্থলে একে-৪৭ বন্দুক-এর মত অস্ত্র সাজিয়ে রাখার নজির পাওয়া গেছে।
এমনকি আফগানিস্তানে মোতায়েন এই বিশেষ বাহিনীর সেনারা একে অপরের সাথে হত্যাকাণ্ডের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল বলে এই তদন্তে উঠে এসেছে।
বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ইমেইল বার্তা যাচাই করে জানা যাচ্ছে যে এসব অবৈধ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এসএএস’র সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবগত ছিলেন। মিলিটারি পুলিশকে এসব তথ্য দেয়ার ব্যাপারে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও তারা তা করেননি।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে তারা মন্তব্য করতে পারছে না। তবে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানানোর অর্থ এই নয় যে অভিযোগের সত্যতা গৃহীত হয়েছে।
‘সর্বশেষ গণহত্যা’
২০১৯ সালে বিবিসি এবং সানডে টাইমস এসএএস ইউনিটের একটি অভিযান তদন্ত করেছিল। তবে এবার নতুন তদন্তের অংশ হিসেবে বিবিসি, এসএএস ইউনিটের রাতের অভিযানের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদনগুলোতে একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারে মিল লক্ষ করা গেছে। আর সেটি হল অভিযান চলাকালীন আটক হওয়া আফগান ব্যক্তিরা পর্দা বা আসবাবের নিচে দিয়ে একে-ফর্টি সেভেন অথবা গ্রেনেড বের করার কারণে তাদেকে হত্যা করা হয়েছে বলে ব্যাখ্যা।
ফাঁস হওয়া নথি। ছবি: বিবিসি।
- ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বরের একটি অভিযানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজনকে আটক করে একটি ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর আটক ব্যক্তি গ্রেনেড ব্যবহারের চেষ্টা করলে তাকে হত্যা করা হয়।
- ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি একজনকে আটক করে একটি ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর আটক ব্যক্তি তোশকের নিচে থেকে গ্রেনেড বের করে ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করে।
- ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ আটক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় কারণ তিনি টহলরত এসএএস সেনাদের রাইফেল দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। ৯ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারির দুটি ঘটনায় একই ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
- ১৬ই ফেব্রুয়ারি দুইজন আটক ব্যক্তিকে হত্যার কারণ হিসেবে বলা হয় তাদের একজন পর্দার আড়াল থেকে গ্রেনেড বের করেন এবং অপরজন টেবিলের নিচ থেকে একে-৪৭ বের করেন।
- এপ্রিলের ১ তারিখ দুইজন আটক ব্যক্তিকে হত্যার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় একজন একে-৪৭ তাক করেছিলেন, অপরজন গ্রেনেড ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করেছিলেন।
বিবিসি এরকম যে কটি অভিযানের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেছে, তার কোনটিতে এসএএস সেনাদের কেউ হতাহত হয়নি। স্পেশাল এয়ার সার্ভিসেস বা এসএএস’র সদর দপ্তরে কাজ করেছেন এরকম একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, এই রিপোর্টগুলো নিয়ে সত্যিকার উদ্বেগ ছিল।
তিনি বলেন, রাতের অভিযানে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিল এবং হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যার কোন অর্থ দাঁড়াচ্ছিল না। যখন কাউকে আটক করা হয়, তার তখনও নিহত হওয়ার কথা না। কিন্তু বিশেষ করে বিভিন্ন ঘটনার একই ধরনের ব্যাখ্যা বারংবার পাওয়ার কারণে সদর দপ্তরে উদ্বেগ তৈরি হয়। কিছু একটা উল্টোপাল্টা যে হচ্ছে সেটা পরিষ্কার ছিল।
বাহিনীর আভ্যন্তরীণ ইমেইলে দেখা যায় কর্মকর্তারা ঘটনার ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবিশ্বাস প্রকাশ করেন। এসব হত্যাকাণ্ডকে এসএএস স্কোয়াড্রনের ”সর্বশেষ গণহত্যা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
হত্যা অথবা আটক
২০১০ সালের নভেম্বরে ছয় মাসের জন্য মোতায়েন করা এসএএসের একটি স্কোয়াড্রনের কার্যক্রমের উপর বিবিসি তার তদন্তে বিশেষ করে মনোনিবেশ করেছে। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গার একটি হেলমান্দে কাজ করছিল স্কোয়াড্রনটি। সেখানে তালেবানদের অতর্কিত হামলা, রাস্তার পাশে বোমা পেতে রাখা এবং সেনাবাহিনীর হতাহতের ঘটনা অনেক বেশি ছিল।
এই স্কোয়াড্রনটির কাজ ছিল তালেবান কমান্ডারদের আটক করা এবং বোমা তৈরির নেটওয়ার্ক অকার্যকর করার জন্য নিয়মিত অভিযান চালানো। এই অভিযানকে বলা হতো “কিল অর ক্যাপচার”। অর্থাৎ “হত্যা অথবা আটক”।
এই অভিযানের টার্গেট নির্ধারণে কাজ করেছেন এমন বেশ ক’টি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, টার্গেট নির্ধারণ প্রক্রিয়ার পেছনে যে গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল তাতে মারাত্মক ত্রুটি ছিল। টার্গেট করা ব্যক্তিদের তালিকায় বেসামরিক নাগরিকদের নাম চলে আসার ঝুঁকি ছিল।
তাদের ভাষায়, খুব তাড়াহুড়ো করে এসব তালিকা তৈরি করা হতো। এমন না যে সবাইকে মেরে ফেলার কথা বলা হতো। কিন্তু কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটা চাপ অবশ্যই ছিল।
অভিযানের সময় এসএএস দল সবসময় একটি নির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহার করতো। তাতে একটি ভবনের সবাইকে তারা বাইরে ডেকে নিয়ে আসতো, শরীর তল্লাসি করা হতো এবং এরপর তাদের বেঁধে ফেলা হতো। এরপর একজন পুরুষ সদস্যকে আবার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হতো বাড়তি তল্লাসি চালানোর জন্য।
কিন্তু অভিযান চলাকালীন আটক হওয়ার সময় পর্দা বা আসবাবের নিচে রাখা গোপন অস্ত্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন বারবার আসার কারণে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উদ্বেগ বোধ করতে শুরু করেন। আফগানিস্তানে উপস্থিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্য কোন ইউনিটের কাছ থেকে এই ধরনের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
কিছু অভিযানে যত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। সেই বিষয়টি নিয়েও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। এসএএস সেনাদের হাতে বেসামরিক নাগরিক মারা যাওয়ার অথবা ঘটনা সাজানোর জন্য সেখানে অস্ত্র ফেলে রাখার সন্দেহ তৈরি হয়।
অস্ট্রেলিয়াতে একই ধরনের সন্দেহ তৈরি হওয়ার পর একজন বিচারককে প্রধান করে তদন্ত পরিচালনা করা হয়। তদন্তে ৩৯ টি অবৈধ হত্যাকাণ্ড এবং অস্ত্র ফেলে রাখার গ্রহণযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে বিষয়টি নিয়ে এতটাই উদ্বেগ তৈরি হয় যে বিশেষ বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচালককে চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে আত্মরক্ষার জন্য নাটক সাজানো, বাঁধা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রমাণ রয়েছে।
এর দুদিন পর পরিচালককে লেখেন যুক্তরাজ্যের বিশেষ বাহিনীর সহকারী প্রধান। তিনি লেখেন এসএএস হয়ত এমন নীতি নিয়ে কাজ করছে যে, “যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন বয়সী পুরুষদের কোন প্রকার ঝুঁকি প্রদর্শন না করা সত্ত্বেও টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।”
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে রয়াল মিলিটারি পুলিশ ‘অপারেশন নর্থমুর’ নামের বিশাল এক তদন্ত শুরু করে। ব্রিটিশ সেনাদের দ্বারা সংঘটিত ৬০০টি ঘটনা এতে তদন্ত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে এসএএস স্কোয়াড্রনের সেনাদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে।
রয়াল মিলিটারি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, তথ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করার সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের বাধা দিয়েছে। ২০১৯ সাল ‘অপারেশন নর্থমুর’ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে কোন ধরনের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রয়াল মিলিটারি পুলিশ বিবিসিকে বলেছে তারা এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। এদিকে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “নতুন করে কোন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। নতুন কোন অভিযোগ এলে তা বিবেচনা করা হবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ