‘৩০ বছর ধরে আমি এই কলেজে শিক্ষকতা করি। ছাত্ররা আমার প্রাণ, স্থানীয়রাও আমাকে ভালোবাসত। তবু আমার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এরপর এই মুখ নিয়ে কী করে আমি কলেজে যাব’- বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পুলিশের সামনে অন্যান্য শিক্ষকদের সামনে একজন শিক্ষকের এমন অপদস্ত হওয়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। পরে যদিও প্রশাসনের জানায়, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে গণমাধমকে স্বপন কুমার জানান ঘটনার পর এক সপ্তাহে দুই বার ঠিকানা বদল করেছেন তিনি।
এদিকে, নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত এই অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
একইসাথে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়া হয়েছে। আকতার হোসেন কলেজটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) রাতে নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক মো: ওমর ফারুকের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
কারণ দর্শানোর চিঠিতে আকতার হোসেনকে বলা হয়েছে, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের এক ছাত্রের মোবাইলে স্ট্যাটাস নিয়ে এক সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আপনি ওই কলেজের একজন শিক্ষক। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে দেখা যায়, আপনার উপস্থিতিতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে বের করে আনা হয়, যা নিন্দনীয় ও শিক্ষকসমাজকে হেয়প্রতিপন্ন করার শামিল।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও মিডিয়ার খবরে আপনাকে জড়িত করে সংবাদ হচ্ছে। সে কারণে আপনি এর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। আমরা মনে করি, আপনি সভাপতি হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী বলেন, আকতার হোসেনকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে
এদিকে বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মশিয়ার রহমানকে বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আকতার হোসেন ফোনে জানান, অব্যাহতিপত্র হাতে পেয়েছি। তবে আমার বিরুদ্ধে শুধু শুধু অভিযোগ করা হচ্ছে। আমি উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে সামলাতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছি। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে, তারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুন একই কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ভারতের বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পরদিন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজের শিক্ষক, ওই শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েক সদস্যকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে পুলিশকে বাধা দেয় উত্তেজিত জনতা। এ সময় শিক্ষক স্বপন কুমারকেও অপদস্ত করা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ