ভারতে প্রতি তিনজন নারীর একজনই সহিংসতার শিকার। সিংহভাগই নির্যাতিত হয় স্বামী না হয় ঘনিষ্ঠ পুরুষ সঙ্গীর কাছে।
২০২০ সালে পুলিশের কাছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৯২ নারী ঘরের ভেতর সহিংসতার অভিযোগ করেছিলেন। তার অর্থ, সে বছর প্রতি পাঁচ মিনিটে পুলিশ এ ধরণের একটি অভিযোগ পেয়েছে।
তবে এমন সহিংসতা শুধু যে ভারতে হচ্ছে তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া হিসাবে, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজনই সহিংসতার শিকার হয় এবং আক্রমণের প্রধান হোতা স্বামী বা ঘনিষ্ঠ পুরুষ সঙ্গী।
ভারতের বেলাতেও এই পরিসংখ্যান একই রকম। তবে নারীর প্রতি এসব সহিংসতা নিয়ে মুখ না খোলার একটি সংস্কৃতি রয়েছে ভারতে। যেটি সবচেয়ে উদ্বেগজনক তাহলো সমাজে এসব সহিংসতা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য।
খাবারে লবণ বেশি হওয়ায় স্ত্রীকে হত্যা ও আরও কিছু ঘটনা
গত মাসে ভারতের মহারাষ্ট্রের রাজ্যে সকালের নাস্তার খাবারে লবণ বেশি হওয়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে পুলিশ ৪৬ বছরের এক পুরুষকে আটক করে।
পুলিশ কর্মকর্তা মিলিন্দ দেশাই বলেন, মুম্বাইয়ের কাছে থানে শহরের ব্যাংক কর্মচারী নিকেশ ঘাগ তার ৪০ বছর বয়সী স্ত্রীকে পিটিয়ে এবং পরে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। কারণ সাবুদানা দিয়ে রান্না করা খিচুড়িতে লবণ বেশি হওয়ায় সে প্রচণ্ড চটে গিয়েছিল।
ওই দম্পতির ১২ বছরের যে ছেলে নিজের চোখে এই হত্যাকাণ্ড দেখেছে, সে পুলিশকে জানায়, তার বাবা বেডরুমে ঢুকে লবণ বেশি হওয়া নিয়ে তার মা নির্মলাকে পেটাতে শুরু করে।
বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে তার বাবাকে থামার জন্য বারবার অনুরোধ করেছে। কিন্তু অভিযুক্ত ঐ ব্যক্তি বউকে পেটাতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে গলায় একটি দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে। হত্যাকাণ্ডের পর ছেলেটির বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে ছেলে তার নানি এবং মামাকে ফোন করে।
পুলিশ জানায়, আমরা যখন ঐ বাড়িতে যাই, তার আগেই পরিবার অচেতন ঐ নারীকে হাসপাতালে নেয়, কিন্তু তার মধ্যেই সে মারা যায়।
অভিযুক্ত স্বামী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিল। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়।
খাবার নিয়ে বচসার জেরে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হওয়ার খবর মাঝে মধ্যেই ভারতের মিডিয়াতে শিরোনাম হয়।
জানুয়ারি মাসে দিল্লির কাছে নয়ডা এলাকায় রাতের খাবার দিতে অস্বীকার করার জন্য স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ একজনকে আটক করে।
২০২১ সালের জুন মাসে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে খাবারের সাথে সালাদ না দেওয়ার জন্য বউকে হত্যার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার মাস ছয় আগে বাঙ্গালোরে ফ্রাইড চিকেন ঠিকমত ভাজা হয়নি বলে বউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়।
২০১৭ সালে বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে রাতের খাবার দিতে দেরি করার জন্য এক লোক গুলি করে তার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে।
বউ পেটানো সমাজে গ্রহণযোগ্য
পরিবার নিয়ে ভারত সরকারের সর্ব-সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় (এনএফএইচএফফাইভ) অবিশ্বাস্য সব চিত্র ফুটে উঠছে।
চল্লিশ শতাংশের বেশি ভারতীয় নারী এবং ৩৮ শতাংশ পুরুষ ঐ সমীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, শ্বশুর বাড়ির লোকদের অসম্মান করলে, পরিবার এবং সন্তানদের ঠিকমত দেখভাল না করলে, স্বামীকে না বলে বাইরে গেলে, যৌন সংগমে আপত্তি করলে, অথবা ঠিকমত রান্না না করলে স্বামীরা স্ত্রীদের পেটাতেই পারেন।
চারটি রাজ্যে ৭৭ শতাংশ নারীই মনে করেন এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীকে পেটানোর অধিকার স্বামীর রয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো অধিকাংশ রাজ্যেই পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বউ পেটানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।
কর্ণাটক ছাড়া আর সব রাজ্যেই পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি বলেছেন, স্ত্রী ঠিকমত রান্না না করলে স্বামীরা তাকে পেটাতেই পারেন।
তবে পাঁচ বছর আগের সমীক্ষা থেকে সর্বশেষ সমীক্ষায় পাওয়া পরিসংখ্যানে এ ধরণের মনোভাব কিছুটা কমার লক্ষণ দেখা গেছে।
যেমন, পাঁচ বছর আগের সমীক্ষায় ৫২ শতাংশ নারী এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ বউ পেটানোর পক্ষে মতামত দিলেও সর্বশেষ সমীক্ষায় এ সংখ্যা যথাক্রমে ৪০ ও ৩৮।
তবে দাতব্য সংস্থা অক্সফামের জেন্ডার সুবিচার বিষয়ক কর্মসূচির প্রধান অমিতা পিত্রে মনে করেন, পরিসংখ্যানে ভিন্নতা চোখে পড়লেও সামগ্রিকভাবে সমাজের মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি।
অমিতা পিত্রে বলেন, এর কারণ, পুরুষ-তন্ত্র সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থান এবং ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয় এবং নারীরা তা হজম করে নেয়। পরিবার এবং সমাজই নারীর বিশ্বাস, মূল্যবোধের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।
ঘরে সহিংসতার শিকার নারীদের সাহায্যে উত্তর প্রদেশে রাজ্যের বুন্দেলখণ্ড এলাকায় ভানাঙ্গানা নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন মাধবি কুকরেজা। অত্যন্ত দরিদ্র এলাকা এটি।
তিনি বলেন, এখানে বিয়ের সময় নববধূদের কানে একটি কথাই বলা হয়, পালকিতে করে তুমি স্বামীর ঘরে ঢুকছো। বের হবে শুধু চিতায় করে।”
ফলে, অধিকাংশ বিবাহিত নারী, এমনকি যারা নিয়মিত পিটুনির শিকার হন তারাও, এই সহিংসতাকে ভাগ্য হিসাবে মেনে নেয়, এবং এ নিয়ে কোনো অভিযোগ অনুযোগ করে না বললেই চলে।
তিনি বলেন, যদিও গত এক দশকে এসব সহিংসতা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু ভারতে বউ পেটানোর বিষয়টি এখনও লোকসমক্ষে আসেনা বললেই চলে। সিংহভাগই মানুষই মনে করে ‘ঘরের বিষয় ঘরেই থাকা উচিৎ।’ সুতরাং নারীদের পুলিশের কাছে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
তাছাড়া, তিনি বলেন, স্বামীর ঘর ছাড়লে তাদের যাওয়ারও আর জায়গা থাকেনা। অনেক সময় সমাজের ভয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়েকে বাবা-মা ঘরে নিতে চায়না। দারিদ্র্য আরেকটি কারণ। মেয়েকে আরেকটি বাড়তি পেট হিসাবে দেখা হয়। সমাজ বা রাষ্ট্র থেকেও সাহায্য নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কিছু শেল্টার হোম। আর পরিত্যক্তা নারীদের যে ভাতা দেওয়া হয় তা নয় মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ রুপি।
ভারতে বিয়েকে অত্যন্ত পবিত্র একটি সম্পর্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয় যে সম্পর্ক আমৃত্যু থাকতে হবে বলে সমাজের বিশ্বাস।
ভানাঙ্গনা প্রকল্পের পুষ্পা শর্মা জানান গত মাসে দুই নারী তাদের দ্বারস্থ হন যাদেরকে তাদের স্বামীরা মেরেধরে শিশু বাচ্চাসহ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
দুটো ঘটনাতেই এই দুই নারীর স্বামীরা চুল ধরে টেনে বাড়ির বাইরে এনে প্রতিবেশীদের সামনে তাদের মারধর করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা ঠিকমত রান্না করেনি। তবে খাবার হচ্ছে সহিংসতা শুরুর প্রধান একটি সূত্র।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ