শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়।
নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে এটি কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য পুরোনো কাঠকয়লার আয়রন মেশিন আর কেরোসিন দিয়ে জ্বালানো বাতির ব্যবহার বাড়ছে শ্রীলঙ্কায়। অনেকের কাছে এটি সৌখিন বলে মনে হলেও আসলে চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামসহ নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কার মানুষ।
বিদ্যুৎ-জ্বালানির তীব্র সংকট এবং খাদ্য ও ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে বৃদ্ধির জেরে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভের একপর্যায়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে শ্রীলঙ্কায় দেশব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় রবিবার দক্ষিণ এশীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “ব্ল্যাকআউট” বা অবরোধ আরোপ করা হয়।
কয়েক ঘণ্টার জন্য টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামে কেউ ঢুকতে পারছিলেন না। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দেশজুড়ে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ থামাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সামাজিক অস্থিরতা ঠেকাতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা মানুষের বিক্ষোভ থামাতে পারেনি।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার সমালোচনা হচ্ছে অনেক। শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক ফারাজ শওকতালি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের বাধামুক্তভাবে প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এটা দেশের আরব বসন্তের মুহূর্ত’।
দেশটির অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলরুকশি হান্ডুনেত্তি বলেন, ‘গত ২০ বছরে আমরা এমন স্বাধীনতা হরণ ও খুশিমতো গ্রেপ্তারের ঘটনা দেখেছি। মানুষ শঙ্কার মধ্যে আছেন’।
আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-এর এশিয়া প্রোগ্রাম ডিরেক্টর স্টিভেন বাটলার বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা তাদের জরুরি অবস্থার সুযোগ ব্যবহার করে যেন ইতিহাসের এমন সন্ধিক্ষণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ না করে, যখন তথ্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি’।
এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এসটিএফ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৩১ মার্চ ছয় জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও অনেককে হেনস্থা করা হয়েছে। তারা সরকার বিরোধী সমাবেশ বিক্ষোভ কাভার করছিলেন।
‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের বাধামুক্তভাবে প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এটা দেশের আরব বসন্তের মুহূর্ত’।
কয়েক দিন ধরেই আলোচনায় শ্রীলঙ্কার চরম আর্থিক দুর্দশা। দেশটিতে বৈদেশিক রিজার্ভ নেই, ডিজেল, বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরকারের কাছে অর্থ নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এত বেশি যে শ্রীলঙ্কার মানুষকে এখন দিনের অর্ধেকের বেশি সময় থাকতে হচ্ছে অন্ধকারে। রাস্তায় চলছে না বাস, গাড়ি। ঘরে বসে অফিস করতে হচ্ছে। কাগজের অভাবে পত্রিকা নেই। আটকে গেছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। চারদিকে এত ‘নেই নেই’–এর মধ্যে মানুষের ক্ষোভও উঠেছে চরমে।
এই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি। ওই দিন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা ঢোকার চেষ্টা করেছেন। রাজাপক্ষে ও ক্ষমতায় থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সামরিক যানে অগ্নিসংযোগ করেছেন। বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আর কঠোর নিয়মকানুন জারি করে এই বিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাজাপক্ষে।
শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থার পাশাপাশি স্থানীয় সময় গত শনিবার ভোর থেকে ৩৬ ঘণ্টার কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজাপক্ষে রাস্তায়, পার্কে, ট্রেনে, সাগরসৈকতে সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া কারও বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছ থেকে মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা বার্তা পেয়েছেন যে হোয়াটসঅ্যাপ কাজ করছে না।
জানা গেছে, বিদেশি ধার-দেনা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে, ভারতের কাছেও ঋণ সহায়তা চেয়েছে দেশটি। গত এক দশকে চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার ফলে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঋণ পুনর্গঠনের অনুরোধও জানিয়েছেন।
সাধারণ মানুষ মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজপাকসে সরকারের ভুল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হচ্ছে তাদের। প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন দেশটির বিরোধী দলগুলো।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলিরা গৃহযুদ্ধের কারণে ভারতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, যার সুযোগ নেওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে গণচীনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছিলেন।
চীনও শ্রীলঙ্কার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়নিজ সিটি নির্মাণসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে প্রকল্প ঋণ প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে যখন হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চায়নিজ সিটি ও কয়েকটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে। যথাযথ ‘প্রকল্প মূল্যায়ন’ পদ্ধতি অবলম্বনে এসব প্রকল্প গৃহীত না হওয়ায় এগুলোর কোনোটাই যথেষ্ট আয়বর্ধনকারী প্রকল্প হয়ে উঠবে না।
এ জন্যই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মহলে বলা হচ্ছে, লোভে পড়ে শ্রীলঙ্কা ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ আটকে গেছে। আরও মারাত্মক হলো, ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল ওই সময়ে, যেগুলোর ম্যাচিউরিটি ২০২২ সাল থেকেই শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এখন তো সুদাসলে ওই বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলঙ্কার নেই।
আপনার মতামত জানানঃ