তালিবানি শাসনের কয়েক মাসেই যে জীবন অসহনীয়, তা জানিয়েছেন এক আফগান রূপান্তরকামী জেবা গুল (নাম পরিবর্তিত)। ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ একটি সাক্ষাৎকারে ১৬ বছরের ওই রূপান্তরকামী বলেন, ‘‘সাজগোজ করতে, মেয়েদের জামাকাপড় পরতে ভালবাসি। নাচতেও ভাল লাগে। তবে আমার বাড়িতে এ সব করা যেত না।
বাড়ির সকলে শিকল দিয়ে বেঁধে পেটাত। এক বার আমার মাথা কামিয়ে দিয়েছিল। জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলত। গালিগালাজও করত।’’
কট্টরপন্থী তালিবানের ভয়ে জেবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তার পরিবার। জেবা বলেন, ‘‘বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেই পার্কে ঘুমোতে হত। টানা তিন দিন ধরে তালিবানের হাতে বেদম মার খেয়েছি। আমাকে ধর্ষণও করেছে!’’
তালিবানি শাসনে সমকাম-বিদ্বেষীদের কড়া নজরদারি বা এই সম্প্রদায়ের প্রতি ভীতি আরও বেড়েছে বলেই মত জেবার। আফগানিস্তানে তাদের এ দশা কেন?
জেবার সাফ জবাব, ‘‘গত বছর ১৪ আগস্ট পর্যন্তও যারা আমার মতো মানুষজনের ক্ষতির চিন্তা করতেন, তারা শাস্তির ভয়ে পিছিয়ে আসতেন। তবে ১৫ আগস্ট থেকে তাদের তো রমরমা। এখন তো আমাদের ক্ষতি করলেও শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই!’’
নিজের পরিবার-পরিজন হোক বা বৃহত্তর সামাজিক পরিসর— আফগানিস্তানে সমকামীদের জায়গা বরাবরই সঙ্কীর্ণ। তা সত্ত্বেও দিনবদলের আশা ছিল। তবে সে আশায় পুরোপুরি পানি ঢেলে দিয়েছে তালিবানি শাসন।
আফগানিস্তানের সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী বা ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ধারীদের জীবনে গণধর্ষণ, মারধর বা প্রাণনাশের হুমকিই এখন নিত্য বাস্তব।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এমনই দাবি করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ ওই আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে দাবি করেছে, ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর তালিবানি শাসকদের মদতে সে দেশে রমরমা বেড়েছে সমকাম-বিদ্বেষীদের।
রূপান্তরকামীদের বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খর্ব হচ্ছে স্বেচ্ছায় লিঙ্গপরিচয় বেছে নেওয়া মানুষজনের অধিকার।
এমনকি গণধর্ষণ, গণপিটুনি কিংবা খুনের হুমকিও পাচ্ছেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ভুক্ত আফগানরা। তালিবানি শাসনে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে আফগান সমআদ্ভেরতিসেমে
তালিবানি শাসনের আগে এই সম্প্রদায়ভুক্তদের জীবন মসৃণ ছিল, এমন নয়। বরং আফগানিস্তানে সমকামিতা নিষিদ্ধ এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নিদান দিয়েছিলেন তালিবানের হাতে ক্ষমতাচ্যুত সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আসরফ গনি।
আউটরাইট অ্যাকশন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের শীর্ষ গবেষক তথা রিপোর্টের এক সমীক্ষক জে লেস্টার ফেডার বলেন, ‘‘গনি সরকারের আমলে সে দেশের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অনেকেই গণধর্ষণ বা পরিবারিক হেনস্থার শিকার। রাষ্ট্র তাঁদের রক্ষক হয়নি।’’
তা সত্ত্বেও নিজস্ব পরিসর খুঁজে পেয়েছিলেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এইচআরডব্লিউ-র মহিলা শাখার অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর হেদার বার বলেন, ‘‘আফগানিস্তানে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন বরাবরই কঠিন ছিল। তবে তারা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে পারতেন।
একে অপরের সমর্থন জুটিয়ে একটা নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। তাদের আশা ছিল, ধীরে ধীরে হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে গত বছরের ১৫ অগস্ট সে সব শেষ হয়ে গিয়েছে!’’
এইচআরডব্লিউ-র রিপোর্টে দাবি, ক্ষমতা দখলের পর থেকে শরিয়ত আইনের দোহাই দিয়ে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অধিকার লুপ্ত করার পথেই এগিয়েছে তালিবান।
গত বছর সংবাদমাধ্যমে এক তালিব মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘‘সমকামীদের জন্য কেবলমাত্র দু’টি শাস্তিই যথেষ্ট। পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা, নয়তো এমন এক দেওয়ালের সামনে দাঁড় করানো যাতে তারা চাপা পড়ে মরবেন।’’
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ