ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে বোমাবর্ষণ করেছে এবং সেগুলো “সম্পূর্ণ ধ্বংস” করা হয়েছে।
রবিবার পেন্টাগন জানায়, এই হামলার পুরো প্রভাব মূল্যায়ন করতে সময় লাগবে, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে—সব স্থাপনাই “চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত” হয়েছে।
ইসরায়েল বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বয় করে এই হামলার পরিকল্পনা করেছে। ইরান স্বীকার করেছে যে এই তিনটি স্থাপনায় হামলা হয়েছে, কিন্তু তারা কোনো বড় ধরনের ক্ষতির কথা অস্বীকার করেছে।
এই হামলা ইরান-ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কোন স্থাপনায় হামলা করেছে এবং কী অস্ত্র ব্যবহার করেছে?
যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ড্যান কেইন জানান, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’-এ ১২৫টি সামরিক বিমান অংশ নেয়, যার মধ্যে ছিল ৭টি বি-২ স্টিলথ বোমার। তিনটি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ফোরদু, নাটানজ এবং ইসফাহান—এই তিনটি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা।
বোমারু বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮ ঘণ্টার যাত্রা শুরু করে, কিছু বিমান প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ছদ্মবেশী ফ্লাইট দেয়, আর মূল আক্রমণ চালায় সাতটি বি-২ বোমার। ইরান সীমান্তে ঢোকার আগেই ইসফাহান স্থাপনাকে লক্ষ্য করে একটি সাবমেরিন থেকে দুই ডজনেরও বেশি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
ইরানের আকাশসীমায় ঢোকার পর, ‘ডিকয়’ বা বিভ্রান্তিকর কৌশল ব্যবহার করে শত্রু বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়ানো হয়।
বোমারু বিমান থেকে দুটি ‘বাংকার বাস্টার’ GBU-57 বোমা ফোরদু স্থাপনায় ফেলা হয়। মোট ১৪টি MOP বোমা দুটি স্থাপনায় ফেলা হয়। এই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় স্থানীয় সময় রাত ১৮:৪০ থেকে ১৯:০৫-এর মধ্যে হামলা হয়। বোমারু বিমানগুলো এরপর ইরান ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়।
জেনারেল কেইন বলেন, “ইরানের যুদ্ধবিমান উড়েনি, এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের ধরতেই পারেনি।”
প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ বলেন, এই হামলার লক্ষ্য ছিল না ইরানি সেনাবাহিনী বা সাধারণ মানুষ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এই মিশন ছিল না শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য।”
তিনি ইসরায়েলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই অপারেশনের পেছনে ছিল মাসব্যাপী পরিকল্পনা ও সমন্বয়।
ফোরদু স্থাপনায় হামলার গুরুত্ব কী?
ফোরদু একটি পারমাণবিক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা, যা গভীর পাহাড়ের নিচে গড়ে তোলা হয়েছে। এটি এতটাই গভীরে যে সাধারণ বোমা দিয়ে এর ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা ১৩,০০০ কেজি ওজনের GBU-57 MOP বোমা ৬০ ফুট কংক্রিট বা ২০০ ফুট মাটি ভেদ করতে পারে।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ২২ জুন ফোরদু স্থাপনায় ছয়টি বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, যেগুলো সম্ভবত বোমা ফেলার স্থান। আশপাশে ধূলিকণা ও ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞ স্টু রে জানান, এই বোমাগুলো ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তৈরি, তাই উপরের অংশে বড় বিস্ফোরণ চিহ্ন দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, টানেলের প্রবেশপথগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, যাতে সেগুলো লক্ষ্যবস্তু না হয়।
ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এই হামলাকে “আন্তর্জাতিক আইনের নৃশংস লঙ্ঘন” বলে মন্তব্য করেছে।
তবে সৌদি আরব ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা IAEA বলেছে, হামলার পর কোনো বিকিরণ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ মেলেনি।
ইরানি টিভিতে বলা হয়েছে, এই তিনটি স্থাপনা “আগেই খালি করে ফেলা হয়েছিল”, তাই ইরান বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।
ইরান কীভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান থেকে তেল আবিব ও হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়, যাতে অন্তত ৮৬ জন আহত হয়।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে এর জবাব পেতেই হবে।”
BBC’র নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলেন, ইরানের সামনে এখন তিনটি পথ:
কোনো প্রতিশোধ না নেওয়া – এতে আর যুক্তরাষ্ট্র হামলা করবে না, কূটনৈতিক আলোচনার পথ খোলা থাকবে, কিন্তু এটা ইরানের অবস্থানকে দুর্বল দেখাবে।
তৎক্ষণাৎ প্রতিশোধ – ইরানের হাতে প্রচুর ব্যালিস্টিক মিসাইল আছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে বা সমুদ্রপথে ড্রোন ও স্পিডবোটে হামলা করতে পারে।
পরবর্তীতে চমকে দেওয়ার মতো প্রতিশোধ – কিছুদিন চুপ থেকে যখন মার্কিন ঘাঁটিগুলো সতর্ক না থাকবে, তখন হামলা চালানো।
ট্রাম্প ও মার্কিন রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্প Truth Social-এ প্রথম এই হামলার কথা জানান। পরে উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং হেগসেথকে সঙ্গে নিয়ে টিভিতে বলেন, “এইবার শুধু শুরু। পরবর্তী হামলা হবে আরও ভয়াবহ, যদি ইরান শান্তির পথে না আসে। মনে রাখবেন, এখনো অনেক টার্গেট বাকি।”
টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। মিচ ম্যাককনেল একে “তেহরানের যুদ্ধবাজদের উপযুক্ত জবাব” বলে অভিহিত করেছেন।
তবে সব রিপাবলিকান সহমত নন। মারজোরি টেইলর গ্রিন বলেন, “এই লড়াই আমাদের না।”
কংগ্রেসম্যান থমাস ম্যাসি যিনি ট্রাম্পকে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া হামলা করতে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন, হামলাকে “অসাংবিধানিক” বলেন। ট্রাম্প তাকে “দু:খজনক হারে পরাজিত” বলে আক্রমণ করেন।
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইরানকে আরও সংঘাত থেকে বিরত থাকতে বলেছে। তারা বলেছে, “ইরান পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে পারবে না” এবং তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে সমর্থন করে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হামলাকে বিপজ্জনক বৃদ্ধি বলে মন্তব্য করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা ক্যালাস উভয় পক্ষকে সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানান।
সৌদি আরব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ওমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে কূটনীতি ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।
রাশিয়ার দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেন, “ট্রাম্প, যিনি নিজেকে শান্তির প্রতীক বলেছিলেন, নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন।”
এই যুদ্ধ কীভাবে শুরু হলো?
১৩ জুন, ইসরায়েল ইরানের অনেক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় আকস্মিক হামলা চালায়। এরপর ইরান শত শত রকেট ও ড্রোনে প্রতিশোধ নেয়।
যুদ্ধের মূল কারণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যা ইসরায়েল মনে করে শিগগিরই পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হবে। ইরান বরাবরই বলে আসছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গাবার্ড মার্চে বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না—এই বিশ্লেষণ ট্রাম্প “ভুল” বলে উড়িয়ে দেন।
ট্রাম্প প্রচারে বলেছিলেন, তিনি “মধ্যপ্রাচ্যে আর কোনো বোকামি যুদ্ধ চান না”, কিন্তু এখন তিনিই একটি নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন।
ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনা চলছিল। মাত্র দুই দিন আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ইরানকে আলোচনার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেবেন, কিন্তু সেই সময়সীমা আর মানা হয়নি।
আপনার মতামত জানানঃ