বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে টানা দুই বছর (২০২২ ও ২০২৩ সাল) রেকর্ড হয়েছে। এই ২৪ মাসে নতুন করে বিভিন্ন দেশে ২৪ লাখের বেশি কর্মী গেছেন। অথচ ২০২৩ সাল শেষে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) তেমন বাড়েনি।
অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা, বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়েও বিদায়ী বছরে প্রবাসী আয় তেমন বাড়ানো গেল না।
প্রবাসী আয় তেমন বাড়াতে না পারার পেছনে অর্থ পাচার ও হুন্ডি–বাণিজ্যের সংশ্লিষ্টতা দেখছেন অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বিদেশে নতুন কর্মী যাওয়ার পর দেশে টাকা পাঠাতে সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। এই হিসাবে ২০২৩ সালে প্রবাসী আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। প্রবাসীদের টাকা ঠিকই দেশে এসেছে, তবে তা ব্যাংক হয়ে বৈধ পথে আসেনি।
আবার কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে প্রবাসী আয় না আসার জন্য বিদেশে গিয়ে অনেক কর্মীর চাকরি না পাওয়ার বিষয়টিকেও কেউ কেউ দায়ী করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় দেশে আসে ২০২১ সালে। সে বছর দেশে মোট ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৯ কোটি ডলার। আর বিদায়ী ২০২৩ সালে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৯১ কোটি ডলার।
অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে মাত্র ৬২ কোটি ডলার বেশি প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। তবে ২০২১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ কোটি ডলার।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে বড় দুই ভরসা হলো—রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয় না বাড়লে রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসী আয় বাড়াতে অর্থ পাচার বন্ধে জোর তৎপরতা নেই। ফলে অর্থ পাচার অব্যাহত আছে। অর্থ পাচারে সহায়তা করতে বিদেশে থাকা হুন্ডি–বাণিজ্যের চক্র প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কিনে ফেলছে। এই চক্র দেশীয় গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রবাসীর পরিবারে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন মানি এক্সচেঞ্জ ও রেমিট্যান্স কোম্পানিগুলো অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল। মহামারির আগের বছর (২০১৯ সাল) সাত লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান। ২০২০ সালে তা ২ লাখে নেমে আসে। অবশ্য ২০২১ সালে তা বেড়ে ৬ লাখ ছাড়ায়।
দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সাল) বিদেশে কর্মী কম গেলেও দেশের ইতিহাসের রেকর্ড প্রবাসী আয় আসে ২০২১ সালে। করোনা মহামারির কারণে লম্বা সময় ধরে বৈশ্বিক যোগাযোগ বন্ধ থাকা ও অর্থ পাচারকারীদের নিষ্ক্রিয়তার জন্যই এই রেকর্ড হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি এবং ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসে।
বিশ্বব্যাংক ও নোমাডের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ ৩৯-এ বলা হয়েছিল, ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক ধারা থাকলেও ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি হবে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, ২০২৩ সাল শেষে আনুষ্ঠানিক তথা বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশের মোট প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পূর্বাভাসের চেয়ে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার কম প্রবাসী আয় এসেছে গত বছর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। তবে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে কিছু ব্যাংক ১২৩ টাকা দামেও প্রবাসী আয় কিনছিল বলে শোনা যায়। কয়েকটি ব্যাংক বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ বাড়াচ্ছে।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রবাসীরা বৈধ পথে আয় পাঠিয়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাচ্ছিলেন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। তার দেড় মাস আগে প্রবাসীদের ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছিল। তবে ব্যাংকের বাইরে হুন্ডি চক্র প্রবাসীদের ডলারের দাম আরও বেশি দিয়ে আসছে।
প্রবাসী আয় কমার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা। তাঁরা বলছেন, যাঁরা আগের বছরগুলোতে অর্থ পাঠিয়েছেন, তাঁরা তো বিদেশেই আছেন। এর সঙ্গে গত বছর লাখো নতুন কর্মী যোগ হয়েছেন। এতে দেশে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ বাড়ার কথা। ব্যাংকের বাইরে অর্থ আসছে বলেই তা দেখা যাচ্ছে না। বিদেশে বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর সুযোগ না থাকায় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরাও হুন্ডি-সুবিধা ব্যবহার করেন ভিসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বছরে ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান ২০১৭ সালে। ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি কর্মী। সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ২০২৩ সালে বিদেশে গেছেন ১৩ লাখের বেশি কর্মী। তবে বিপুল বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মধ্যে অনেক প্রবাসী ‘ব্যর্থ’ হয়ে দেশে ফিরছেন।
দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে সব হারিয়ে, বিদেশে পুলিশের হাতে আটক হয়ে, একদম বাধ্য হয়ে, শূন্য হাতে যাঁরা দেশে ফিরে আসেন; শুধু তাঁদের হিসাবই আছে। কারণ, এমন প্রবাসীর হাতে পাসপোর্ট থাকে না। দেশে ফেরার জন্য দূতাবাস থেকে তাঁদের একটি আউট পাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) সরবরাহ করা হয়। এই আউট পাস নিয়ে ফিরে আসা কর্মীদের হিসাব আছে সরকারি সংস্থার কাছে।
সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন ৮৬ হাজার ৬২১ প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ ৮৩ হাজার ৭১৯ এবং নারী ২ হাজার ৯০২ জন। তবে এর বাইরে যাঁরা পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফিরেছেন, তাঁদের কোনো হিসাব নেই এ সংস্থার কাছে।
অভিবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যর্থ অভিবাসনের প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক। বছরে এ সংখ্যা লাখের বেশি হবে।
দেশে ফিরে আসা ২১৮ প্রবাসীর ওপর সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়েছে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠার রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। জরিপের আলোকে তারা বলছে, বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি ১৫ শতাংশ কর্মী। ২০ শতাংশ কর্মী চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি। এসব কর্মীর দেশে ফিরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
রামরুর জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের ১৫ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার ১ মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন। আর ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফেরেন ২৯ শতাংশ কর্মী। বিদেশে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ধারদেনায় জড়িয়ে যান এসব কর্মী।
অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, যে ধরনের কাজে বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন, সেসব কাজের জন্য অন্যান্য দেশ থেকে দক্ষ কর্মীরা যাচ্ছেন। তাই বিদেশের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা কমছে। তাঁরা বেশি আয় করতে পারছেন না। আবার অনেকে গিয়ে নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন না। দক্ষ কর্মী পাঠাতে না পারলে প্রবাসী আয় বাড়বে না।
বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের (সিএমএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, হুন্ডির মাধ্যমে অধিক মাত্রায় অর্থ পাঠানোর কারণে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হুন্ডির প্রতি আগ্রহী হওয়ার সঙ্গে অভিবাসন ব্যয়ের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ঋণ নিয়ে উচ্চ খরচে বিদেশে যান প্রবাসীরা। তাঁরা দেশে দ্রুত অর্থ পাঠিয়ে এই ঋণ পরিশোধ করতে চান। তাই যে মাধ্যম বেশি মুদ্রা বিনিময় হার দেয়, তাঁরা সেই মাধ্যমই ব্যবহার করেন।
গবেষণায় উঠে আসে, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। তারা অভিবাসীদের কম সময়ে, কম খরচে দেশে অর্থ পাঠানোর নিশ্চয়তা দেয়। কোনো প্রবাসী কোনো মাসে অর্থ পাঠাতে না পারলে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে ধার দিয়ে দেশে অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। প্রবাসীরা পরের মাসে তা শোধ করতে পারেন। অথচ, দ্রুত বর্ধমান ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রবাসীদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হুন্ডির চেয়ে ব্যাংকে অর্থ পাঠিয়ে যদি একই রকম সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে প্রবাসীরা উদ্বুদ্ধ হবেন, তা করা গেলে ২ হাজার ২০০ কোটি থেকে প্রবাসী আয় বাড়িয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে ডলারের দরের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বদলে হুন্ডি বা অন্য উপায় বেছে নিচ্ছেন অনেক প্রবাসী। ফলে দেশে প্রবাসী পরিবারে টাকা এলেও ডলার সীমান্ত অতিক্রম করছে না। তাই বিদেশে বেশি কর্মী যাওয়ার পরও প্রবাসী আয় তেমন বাড়ছে না।
আপনার মতামত জানানঃ