বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে আধা সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত – সব পেশাতেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি দলকে সমর্থনের জন্য প্রচণ্ড চাপের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকতে আগ্রহী কর্মীরা।
দেশে বিভিন্ন পেশার সাবেক এবং বর্তমান বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ ধারণা পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, এ কারণেই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে সরকারি দলের অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে বক্তব্য, বিবৃতি কিংবা কর্মসূচি পালনের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
একই অবস্থা তৈরি হয়েছিলো গত মার্চে দৈনিক প্রথম আলোর ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত একটি ফটো কার্ডকে ঘিরেও।
সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করায় সরকার এবং সরকার সমর্থকদের রোষে পড়েছেন একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
বিশ্লেষকরা বলছেন ক্ষমতাসীন দল বা তাদের অবস্থানকেই সমর্থন করতে হবে- এমন পরিবেশ তৈরিতে ক্ষমতাসীন দলের অনুগতদের নেতৃত্বে গঠিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোই বেশি ভূমিকা রাখছে। তাদের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করলে হেনস্থার শিকার হওয়ার উদাহরণও তৈরি হয়েছে এখন দেশে।
এমনকি প্রথম আলো এবং অধ্যাপক ইউনূস ইস্যুতে কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠন থেকে দেয়া বিবৃতিতে অনুমতি বা কোনো যোগাযোগ ছাড়াও অনেকের নাম ব্যবহারের অভিযোগও এসেছে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বিবিসিকে বলছেন, সবক্ষেত্রেই পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘পেশাজীবী কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা’ এবং তারা নিজেদের সুবিধা লাভের স্বার্থে সরকারি দলের মতো করে কথা বলছেন।
তিনি বলেন, “কিছু ইস্যুতে সবার বিবৃতির ভাষাও অনেকটা একই থাকে। বোঝাই যায়, এগুলো কোথাও তৈরি করে তারপর সবাইকে দেয়া হয়।”
তবে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া অবশ্য বলছেন আওয়ামী লীগের অবস্থানের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে কাউকে কখনো জোর করা হয়নি।
তিনি বলেছেন, “তবে দেশের বা জনগণের স্বার্থে কেউ কিছু বললে, সেটা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে গেলে তো করার কিছু নেই। বরং প্রতিটি নাগরিক বা সংগঠনের দায়িত্বই তো হলো দেশ বিরোধী চক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করা হলে এসব দেশবিরোধী শক্তির উত্থানই হত না,” ।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বরাবরই অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে কথিত ‘দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করে আসছেন।
সব পেশাতেই চাপ!
সম্প্রতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা খোলা চিঠির প্রতিবাদে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
অধ্যাপক ইউনূসের সাথে ‘বিচারিক হয়রানি’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকার কথা জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া।
অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে মি. ইউনূসের পক্ষে আসা বিবৃতিসমূহের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দেয়ার কথা ছিল বলে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন এমরান ভুঁইয়া। যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কিন্তু আইনমন্ত্রী আনিসুল হক পরে বলেছেন ভুঁইয়া শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। এছাড়া সরকারি দলের সমর্থকরা অনেকেই মি. ভুঁইয়াকে বিরোধী দলের এজেন্ট কিংবা ছাত্রজীবনে তিনি বিএনপি সমর্থিত ছিলেন এমন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ভুঁইয়ার ঘনিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন যে তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতেই সক্রিয় ছিলেন।
বাংলাদেশে সরকারি দলের চিন্তা ধারার বাইরে গেলে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়া নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন পেশায় ছিলেন বা আছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে বিবিসি বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছে, যদিও তাদের অনেকেই নিজের নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এমনকি অবসরে থাকা কয়েকজনও ‘অযাচিত ঝামেলা’ এড়াতে তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
তবে তারা বলছেন সরকারি চাকুরী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি জগতসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কখনো রাষ্ট্রযন্ত্র, আবার কখনো সরকার অনুগামীদের একটি অংশ নিজেদের মতের পক্ষে থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সদস্যদের ওপর নানা কায়দায় চাপ তৈরি করে।
সাবেক একজন যুগ্ম সচিব বলছিলেন, “তারা আসলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে যে মনে হবে তাদের মতের বাইরে গেলেই আপনি হবেন সরকার বিরোধী। অথচ তারা শুধু সরকারি দলের পারপাস সার্ভ করে, সরকার বা দেশের নয়।”
আবার এবার অধ্যাপক ইউনূস ইস্যুতে ওবামা-হিলারিদের বিবৃতির প্রতিবাদ করে বিবৃতি এসেছে ৫০ জন সম্পাদকের পক্ষ থেকে।
যদিও অভিযোগ এসেছে এ ক্ষেত্রে কারও কারও অনুমতি ছাড়াই বিবৃতিতে তাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্যবহৃত হচ্ছে সমিতি-সংগঠন
সরকারি চাকুরেদের বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে সরকারি দলের সঙ্গে অতীতে জড়িত ছিলেন, এমন ব্যক্তিরা স্থান পাওয়ার পর সেগুলোকে সরকারি দলের স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে পুলিশ, প্রশাসনসহ সব ক্যাডারদের সংগঠন ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে অনেক পেশাজীবী সংগঠন আছে।
মূলত সংগঠনের সদস্যদের কল্যাণে তাদের ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও বিভিন্ন সময়েই গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে তারা সরকারি দল আওয়ামী লীগের অবস্থানকেই সমর্থন করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আসছেন।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলছেন, পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে এখন আর প্রকৃত অর্থে নির্বাচন হয় না। বরং দলীয় অনুগতদের জেতাতে ‘একতরফা নির্বাচনে জোর করে’ এমনভাবে নির্বাচন করা হয় যাতে সব পক্ষের অংশ নেয়ার পরিবেশই থাকে না।
এক্ষেত্রে কেবল চাকুরীজীবী নয়, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সংগঠনে এমন ঘটনা ঘটতে দেখো গেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সামরিক শাসন বিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামে দেশের পেশাজীবী সংগঠনগুলো বরাবরই সক্রিয় ছিলো। এমনকি নব্বই সালে জেনারেল এরশাদের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর শাসন শুরু হলেও এসব পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিজেদের সদস্যদের দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার থেকেছে।
কিন্তু প্রথম আলো ইস্যুতে এবং কয়েকদিন আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে দেখা যাচ্ছে ঢালাও ভাবে সব পেশাজীবী সংগঠনই সরকারি দল আওয়ামী লীগের অবস্থান সমর্থন করে বিবৃতি দিচ্ছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিবৃতির ভাষাও প্রায় এক।
চলতি বছর স্বাধীনতা দিবসের আগে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে ব্যবহৃত একটি উদ্ধৃতি ফেসবুকে কার্ড আকারে প্রকাশ করার পর সরকারি দল আওয়ামী লীগ ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়।
এতে পত্রিকাটির সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলাও হয়। ওই ঘটনার জের ধরে প্রায় প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনই সরকারের অবস্থানের পক্ষে নিজেদের বক্তৃতা বিবৃতি দিতে শুরু করে।
এমনকি কয়েকটি সংগঠন প্রথম আলোর বিরুদ্ধেও মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে সেসময়।
পরিবর্তন ২০০৯ সাল থেকেই
এবারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনসহ দেড়শও বেশি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব বিবৃতি দেয়ার পর তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই মূলত পেশাজীবী সংগঠনগুলোর বিবৃতি ও কর্মসূচির ঝড় ওঠে ওই বিবৃতির বিপক্ষে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর স্বকীয়তা হারিয়ে নিজেদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে ঘিরে একটা দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যার একটি উদাহরণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “এক পক্ষ সরকারি দল সমর্থক এবং অন্য পক্ষ বিরোধী দল সমর্থক। যারা জড়িত ও নেতৃত্বে এরা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সংগঠনকে ব্যবহার করে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংগঠন আসলে শিক্ষকদের জন্য এখন কিছু করে না। এখানে নীল দল আওয়ামী লীগের ঢাবি শাখা আর সাদা দল বিএনপির ঢাবি শাখা।”
দেশের অপরাপর শিক্ষক সমিতিগুলোও একই সুরে কথা বলেছে বলে জানান তিনি। প্রথম আলোর ঘটনার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদের বদলে প্রথম আলোর খবরটির নিন্দা করেছিলো।
সমিতির নেতারা বলেছিলেন, “পত্রিকাটিতে সংবাদ প্রকাশের নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা চালানো হয়েছে”। এবারেও অধ্যাপক ইউনূসের নোবেল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আলোচনায় এসেছে এই সংগঠন।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, “এদের কর্মকাণ্ডে বেশিরভাগ শিক্ষকই বিরক্ত। কারণ ওনারা পেশার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছেন, যে কারণে আমরা হাস্যকর হয়ে ওঠছি”।
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, সরকারি দলের অনুগত হয়ে নয়, বরং তারা স্বাধীন ভাবেই শিক্ষকদের মতামত নিয়েই নিজেদের মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “ড: ইউনুস আইন লঙ্ঘন করেছেন। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। হিলারি ক্লিনটনসহ অন্যরা বিচার বন্ধ করতে বলেছেন। এটা দেখে তো আমরা চুপ থাকতে পারি না। আর প্রথম আলো সরকারের অগ্রগতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছিলো বলে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম।”
আপনার মতামত জানানঃ