বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পে চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এই চাপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চলমান দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলছে। জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে এতথ্য জানিয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ঋণে তৈরি বড় দুটি প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা সেতুর রেল সংযোগে ঋণের কিস্তি বাংলাদেশকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেওয়া শুরু করতে হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ১ হাজার ১৮৮ কোটি ডলারের ঋণ চলতি বছরের শুরু থেকেই পরিশোধ শুরু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এই ঋণের কিস্তির কিছু অর্থ এসক্রো অ্যাকাউন্টে আটকে আছে। এসক্রো অ্যাকাউন্ট হলো দুই পক্ষের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে আইনিভাবে নিয়োজিত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খোলা হিসাব।
২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বা মান কমে যাওয়াও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে এশিয়ায় সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পড়া শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক স্বস্তিদায়ক হলেও রিজার্ভ নিয়ে টানাটানি কমছে না।
এই পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা না করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কামাল মুজেরী। তিনি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ‘পরিস্থিতির যথাযথ ব্যবস্থাপনা না হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হতে পারে।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারকে আরো ৩২৮ কোটি ডলারে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। রিজার্ভ কমার কারণ হিসেবে ইউক্রেন সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে কিছুটা দায়ী করা হয়।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠোর মানদণ্ড বিবেচনায় রিজার্ভের পরিমাণ কমে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি নামতে পারে। রিজার্ভ বাড়াতে এবছরের শুরুর দিকে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে এই অর্থ খুব বেশি ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না বলে সংশ্লিষ্টদের মত।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। কারণ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় তাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় কম এবং সুদের হারও বেশি।
তারা বলছেন, ২০১৫ সালের পর থেকে সুদের হারসহ নানা কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ব্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ওই বছর বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর থেকেই ঋণদাতারা সফট লোন বা স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তের ঋণসুবিধা বাদ দিয়েছে।
এখন তারা ‘ব্লেন্ডেড লোন’ বা মিশ্র পদ্ধতির ঋণ দিচ্ছে, যেখানে সুদের হার মাঝারি হয়। ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত দ্বিপক্ষীয় ঋণগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চ সুদহার এবং কঠোর শর্ত বেশি দেওয়া হয়।’
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই উচ্চ ব্যয়ের ঋণ বেড়ে গেছে। দেশের অর্থনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়েছে।
মিজানুর রহমান বলেন, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি মওকুফকাল ও পরিশোধের মেয়াদ দুটোই কম। বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড থাকে ১০ বছর। অথচ রাশিয়া ও চীনের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড এর অর্ধেক।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেয়। বিপরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয় ঋণ পরিশোধে সব মিলে গড়ে ১৫ বছর সময় পাওয়া যায়। সময়সীমা কমার কারণে আগের চেয়ে ঋণের কিস্তির আকার যথেষ্ট বড় হয়েছে।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের জন্য ৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ নিতে ২০১৫ সালের জুনে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। পরে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিলে আরও ২৬৭ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি চুক্তি করে। ইআরডির তথ্য বলছে, চীন থেকে নেওয়া বাংলাদেশের মোট ঋণ এখন ১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার।
এসব প্রকল্পের বহু আগে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়। কিন্তু এই প্রকল্পের কিস্তি এখনো বাকি। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়াকে ঋণ পরিশোধে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ তৃতীয় মুদ্রায় (চীনা ইউয়ানে) অর্থ পরিশোধ করতে চাইছে। এ জন্য গত ৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠিয়ে চীনের পিপলস ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছে ইআরডি।
সব মিলে বাংলাদেশের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৪৫ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে পরের অর্থবছরে ৮ হাজার ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। তবে এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি শঙ্কার নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমানের। তাঁর মতে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ খুব বেশি নয়।
২০২২ সালের জুন নাগাদ দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল মোট জিডিপির মাত্র সাড়ে ২০ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বিবেচনায় নিলে ঋণ পরিশোধের অঙ্কটা খুব বড় নয়। অধ্যাপক মিজানুর বলেন, ‘তবে যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, তাই আমাদের খুব বেশি সতর্ক হতে হবে।’
তবে বিপদের এখানেই শেষ নয়, আরও আছে সামনে। কারণ, ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে চলে যাবে। এর সহজ অর্থ, বিশ্ববাজারে প্রবেশে বাংলাদেশি পণ্য আগে যে ছাড় পেত, তা পাবে না। এর ফলে দেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই এই মুহূর্তে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
মোস্তফা কামাল মুজেরীর মতে, গত দশকে বাংলাদেশে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে ও অর্থনীতি ত্বরান্বিত হয়েছে। এর ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদাও তৈরি হয়েছে। এই চাহিদাই সরকারকে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোসহ নানা কারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোর কাঙ্ক্ষিত সুফল ও বাস্তবতার মধ্যে সব সময় ফারাক থেকে গেছে। এ কারণে অনেক প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ বোঝায় পরিণত হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষ ও সতর্ক হতে হবে।
মুজেরী আরও বলেন, ‘যখন থেকে আমরা একই সময়ে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছি, তখন থেকেই আমাদের ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে এবং এটি বাড়তেই থাকবে। তাই সামনের দিনে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি হিসেবি হতে হবে।’
এসডব্লিউএসএস/২৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ