কথা বা স্পিচ হলো যোগাযোগের জন্য জটিল শব্দের উচ্চারণ। এটি এমন এক ক্ষমতা যা মানুষ তোতাপাখি, ডলফিন, হাতি এবং এমনকি সী লায়নের সাথে কিছুটা হলেও ভাগ করে নেয়, তবে বানরের সাথে নয়। বানরকে কথা বলতে শেখানোর প্রচেষ্টা বেশ কয়েকবার করা হলেও তা সফল হয়নি বললেই চলে।
ভিকি, মানুষের কাছে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা শিম্পাঞ্জি, শুধু মা এবং বাবার মতো কয়েকটি শব্দ শিখতে পেরেছিল। বিখ্যাত গরিলা কোকো যে যোগাযোগের জন্য এক হাজারেরও বেশি হ্যান্ড সাইন শিখেছিল, কখনও একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। অদ্ভুতভাবে তাদের এই অক্ষমতার সেরা ব্যাখ্যা এসেছে হরিণ, বিড়াল এবং কোয়ালা থেকে, যদিও এই ব্যাখ্যা পাওয়ার যাত্রা সহজ ছিল না। তোতাপাখি কথা বলতে পারলেও বানর কেন পারে না, এর ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস-এ।
চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, বানরদের কথা বলার মতো শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও প্রয়োজনীয় নিউরাল মেকানিজমের অভাব রয়েছে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় পূর্বানুমান (হাইপোথিসিস)। এরপর সায়েন্স জার্নালে ফিলিপ লিবারম্যানের গবেষণা প্রবন্ধ এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়।
লিবারম্যান একটি বানরের মৃতদেহের ভোকাল অ্যানাটমি নিয়ে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, অন্যান্য প্রাইমেটরা তাদের স্বরযন্ত্রের অবস্থানের কারণে মানুষের মতো এত বেশি স্বর তৈরি করতে পারে না। নবজাতক মানুষের স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংক্স ঘাড়ের একেবারে ওপরে থাকে, তবে দুই বছর বয়সে এটি স্থায়ীভাবে নিচে নেমে আসে। এই পরিবর্তন অন্য প্রাইমেটদের মধ্যে ঘটে না।
লিবারম্যানের আবিষ্কার এই ধারণাটিকে বদ্ধমূল করে যে, কথা বলার পূর্বশর্ত হলো নিচে নেমে আসা ল্যারিংক্স। প্যালিও-অ্যানথ্রোপোলজিস্টরা অন্যান্য হোমিনিডদের ফসিল অনুসন্ধান করতে শুরু করেন, যার মাধ্যমে ফসিলগুলোর ল্যারিংক্সের অবস্থান নির্ণয় করে তারা ভাষার উৎপত্তি কবে হয়েছে তা সম্পর্কে অনুমান করতে পারবেন।
লিবারম্যান এরপর নিয়ান্ডারথালদের কণ্ঠনালীর সফট টিস্যু পুনর্গঠন করে দেখেন এবং ফলাফল থেকে অনুমান করেন যে, তাদের স্বরযন্ত্রটি মানুষের তুলনায় অনেকখানি ওপরে ছিল, অনেকটা শিম্পাঞ্জির স্বরযন্ত্রের মতো। তিনি দাবি করে বসেননি যে, নিয়ান্ডারথালরা কথা বলতে পারতো না, তবে অন্যান্য হোমিনিডদের কথা বলার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন লিবারম্যান।
বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ডব্লিউ. টেকুমসেহ ফিচ একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন, এখনো পর্যন্ত যা যা প্রমাণ রয়েছে তার সবগুলোই করা হয়েছে মৃত প্রাণীর দেহ পরীক্ষা করে। ফিচ আশ্চর্য হন যে, কেন জীবিত প্রাণীদের কথা বলার সময় তাদের ভোকাল ট্র্যাক্টের অবস্থান নিয়ে পরীক্ষা করা হয়নি। ফিচ এই কাজটিই করেন।
জীবিত প্রাণীদের কথা বলার সময় এক্স-রে ইমেজিং ব্যবহার করে ভোকাল ট্র্যাক্টের অবস্তাহ্ন পরীক্কাহ করছিলেন। তার পর্যবেক্ষণে তিনি আবিষ্কার করেন যে, ল্যারিংক্সগুলো স্বাভাবিক অবস্থাত উঁচু অবস্তাহ্নে থাকে, তবে কথা বলার সময় মানুষের ল্যারিংক্সের মতো নিচে নেমে আসে।
তবে ফিচের গবেষণায় দেখা যায় যে, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভোকাল ট্র্যাক্ট গতিশীল, যা অন্যান্য প্রাইমেটদের কথা বলার ক্ষমতা সম্পর্কে লিবারম্যানের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে।
ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে ফিচ লিখেছেন, “সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী যা করতে সক্ষম প্রারম্ভিক হোমিনিডরাও একই পদ্ধতিতে স্পষ্ট এবং বোধগম্য ধ্বনি তৈরি করতে পারতো। আর তা হল: কথা বলার সময় সময় ভোকাল অ্যানাটমির পরিবর্তন করা।”
যা-ই হোক, তখনো পর্যন্ত মানুষকে স্থায়ীভাবে নিচে নেমে আসা ল্যারিংক্সসহ একমাত্র প্রাণী বলে মনে করা হতো। ফিচের গবেষণা প্রকাশের পরপরই তিনি হরিণ বিশেষজ্ঞ ফরাসি জীববিজ্ঞানী ডেভিড রেবির কাছ থেকে একটি ই-মেইল পান। রেবি হরিণের কথা বলার সময় তাদের গলার ভেতরে অদ্ভুত নড়াচড়া নিয়ে ফিচের ধারণা সম্পর্কে জানতে চান, যা তিনি হরিণের শব্দ উৎপাদনের সময় পর্যবেক্ষণ করেন।
ফিচও পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে পান, হরিণের স্বরযন্ত্র অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতোই, তবে হরিণের ল্যারিংক্স স্বাভাবিক অবস্থায় গলার মাঝখানে থাকে, অনেকটা মানুষের স্বরযন্ত্রের মতো।
২০০১ সালে ফিচ এবং রেবি একত্রে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন এবং জানান, “নিচে নেমে আসা ল্যারিংক্স মানবদেহের অনন্য জিনিস নয়।”
ফিচ এরপর মানুষের মতো ল্যারিংক্সের অবস্থান রয়েছে এমন প্রাণী খোঁজা শুরু করেন। তিনি দেখতে পান যে, প্যানথেরা (সিংহ, বাঘ, জাগুয়ার এবং চিতাবাঘ) গণের সমস্ত প্রজাতির মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মারসুপিয়ালদের ব্যবচ্ছেদ করতে তিনি অস্ট্রেলিয়া যান এবং আবিষ্কার করেন যে, কোয়ালাদেরও ল্যারিংক্সও মানূষের মতো।
ল্যারিংক্সের এই নিচু অবস্থান অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও আবিষ্কার করার পর কথা বলার জন্য এটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়। যদিও সিংহের গর্জন নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক, তারপরও সেগুলো একেবারেই সরল, জটিল উচ্চারিত শব্দের ধারেকাছে নেই। এসব নতুন আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ল্যারিংক্সের আকার নিয়ে আরেক হাইপোথিসিসের জন্ম দেয়।
বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীর চেয়ে লো-পিচে কথা বলে, কারণ তাদের লম্বা কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি ভোকাল ফোল্ডও বড়। প্রাণীর আকারের সাথে শব্দের পিচের সম্পর্কের একটি কারণ এটি। তাই নিশাচর এবং গভীর বনে বাস করা প্রাণীরা গভীর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে নিজেদেরকে বড় আকারের প্রাণী প্রমাণ করে সম্ভাব্য হুমকিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে।
যখন একটি ল্যারিংক্স নিচে নেমে আসে, তখন এটি ভোকাল ট্র্যাক্টকে লম্বা করে ফেলে এবং এর ফলে গভীর কণ্ঠস্বর হয়। মানবদেহের মধ্যেই এটি সুস্পষ্ট। বয়ঃসন্ধিকালে পুরুষদের শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন হয়, যার ফলে তাদেরকে আকারে বড় দেখায়। কাঁধ প্রশস্ত হয়ে ওঠে, দাড়ি গজায় এবং ল্যারিংক্স দ্বিতীয়বার নিচে নেমে আসে।
ফিচ লিখেছেন, “ল্যারিংক্সটি মূলত হোমিনিডের ভোকাল ট্র্যাক্ট বড় করার জন্য নিচে নেমে আসে,যা কথা বলার একটি পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে।” এটি এর আগের পূর্বধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে হোমিনিডরা কথা বলতে পারে না।
এই সব গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, বাঁদরের কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু তাদের কথা বলতে না পারার অক্ষমতার কারণ সম্পূর্ণ স্নায়বিক। মানুষ তাদের ল্যারিংক্স খুব চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে এটি তাদের অবস্থানের জন্য নয়, বরং মস্তিষ্কের সাথে নিউরাল সংযোগের কারণে। তোতাপাখির স্বরযন্ত্রই নেই, তারপরেও তাদের কথা বলার অঙ্গের ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ থাকায়, তারা বোধগম্য শব্দ এবং বাক্যাংশ উচ্চারণ করতে সক্ষম।
তুলনামূলক গবেষণার গুরুত্বের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ এটি, যেখানে আমরা অন্যান্য প্রজাতিকে অধ্যয়ন করে তাদেরকে এবং নিজেদেরকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি। এবং আবারও, ডারউইনই সঠিক ছিলেন।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ