নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চক্রের সাহায্যে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করতেন পুলিশের দুই সদস্য। তাদের একজন হলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার থানার এএসআই মাসুম শেখ(৩৩) এবং গেন্ডারিয়ার আরআরএফ মিলব্যারাকের এএসআই শহীদ শেখ(৫৫)। ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির মাধ্যমে সাড়ে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ওই দুই পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, আসামি এএসআই শহীদ ও মাসুম শেখ বেশ কিছু দিন ধরে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে আসছিলেন।তাদের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করতো। এমনকি এসব কাজে ব্যবহার করা হতো সরকারি অস্ত্র, গাড়ি ও হ্যান্ডকাফ। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওই দুই এএসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চলছে বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির লালবাগ বিভাগের এসি ফজলুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এএসআই শহীদ শেখ ও মাসুম শেখ দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে আসছিলেন। তাদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি অপরাধীচক্র রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে আসছিল। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর শহীদ ও মাসুমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ও একটি প্রাইভেট কার।
জানা যায়, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে এএসআই শহীদ, মাসুম শেখসহ চক্রের সদস্যরা অনেকগুলো ডাকাতি করেছেন। ডিবি পুলিশের পরিচয়ে এই অপরাধী চক্রের সদস্যরা এমনভাবে ডাকাতি করত যে ভুক্তভোগীদের বোঝার উপায় থাকত না, তারা আসলে ভুয়া ডিবি। কারণ, পিস্তল, হ্যান্ডকাফ সবই পুলিশের।
এই দুই পুলিশ সদস্যের বাইরে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন মহসিন শেখ। তার নামে ছয়টি মামলা আছে। এর মধ্যে চারটি মামলা প্রতারণার। প্রতারক চক্রের অপর সদস্য হলেন আনিছুর রহমান। দুজনই ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে পুলিশ সদস্য শহীদ ও মাসুম শেখের নাম উল্লেখ করেছেন। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের ছয় সদস্যের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।
তবে এএসআই মাসুম শেখের গ্রেপ্তারের বিষয়ে মুখ খোলেনি আড়াইহাজার থানা পুলিশ। আড়াইহাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শওকত হোসেন জানিয়েছেন, এএসআই মাসুম শেখ সপ্তাহখানেক ধরে ছুটিতে রয়েছেন।
মামলার নথিপত্রের তথ্য থেকে জানা গেছে, আবদুল আওয়াল নামের এক ব্যক্তি রামপুরার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি রামপুরার টিভি সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তখন কথিত বাবু নামের এক ব্যক্তি আওয়ালের কাছে এসে বলেন, পেশায় তিনি রিকশাচালক। তিনি লেখাপড়া জানেন না। ১০০ সৌদি রিয়াল ভাঙানোর জন্য তিনি সাহায্য চান।
কথোপকথনের একপর্যায়ে আওয়াল ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চান, এসব রিয়াল তিনি কোথায় পেয়েছেন? জবাবে বাবু জানান, তার পরিচিত একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ওই রিয়াল রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন। কথিত রিকশাচালক বাবুর কথায় বিশ্বাস করে রিয়াল ভাঙিয়ে দেন আওয়াল।
পরে কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দারকে আওয়ালের কাছে হাজির করেন বাবু এবং আরও ১ হাজার ৮৬০ রিয়াল ভাঙানোর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষক আওয়ালকে অনুরোধ করেন কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দার।
এরপর আওয়ালকে রামপুরার লেহাজ হোটেলের সামনে আসতে বলেন বাবু ও হায়দার। প্রলোভনে পড়া মাদ্রাসা শিক্ষক আওয়াল রিয়ালগুলো নেওয়ার জন্য নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে আসেন লোহাজ হোটেলের সামনে।
আওয়াল পাঁচ লাখ টাকা বাবু ও হায়দারকে বুঝিয়ে দেন। তখন বাবু ও হায়দার আওয়ালের হাতে প্যাকেটভর্তি কথিত রিয়াল তুলে দেন। তখনই সেখানে একটি প্রাইভেট কার এসে থামে। প্রাইভেট কার থেকে নেমে তিনজন ব্যক্তি আওয়ালের কাছে আসেন এবং নিজেদের ডিবি পুলিশের পরিচয় দেন।
আওয়ালকে জোর করে প্রাইভেট কারে তুলে হ্যান্ডকাফ পরান কথিত ডিবি পুলিশের সদস্যরা। রিয়ালগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন, কাগজপত্র কোথায়- ইত্যাদি নানা কথা জানতে চায় ডিবি পরিচয় দেওয়া তিন ব্যক্তি। আওয়ালকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর কথা জানান তারা। তাকে অবৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরার হুমকিও দেওয়া হয়। তবে ১০ লাখ টাকা দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
একপর্যায়ে তার ব্যাংক হিসাবে যত টাকা আছে, তা দেবেন বলে জানান আওয়াল। আওয়ালের ব্যাংক হিসাব থেকে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা তুলে নেয় কথিত ডিবি পুলিশের দল।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, মাদ্রাসা শিক্ষক আওয়ালের কাছে প্রথমে যিনি রিকশাচালকের পরিচয় দিয়ে রিয়াল ভাঙানোর ফাঁদ পেতেছিলেন, আসলে তিনি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। তার প্রকৃত নাম আনিছুর রহমান। আর হায়দার পরিচয় দেওয়া কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হলেন প্রতারক চক্রের আরেক সদস্য শওকত। ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে আওয়ালের কাছ থেকে যারা টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, তারা ডিবি সদস্য নন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন এএসআই মাসুম শেখ।
আইন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের এই ডাকাতির চিত্র থেকে পুলিশ বাহিনীর বর্তমান সার্বিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। এর আগে চলতি মাসেই পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক চালান, ধর্ষণ, এবং অবৈধ অস্ত্র বিক্রির অভিযোগ উঠে আসে। সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম পুলিশের হাতে উঠে আসাতে দেশের পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তারা। ক’দিন আগেই সিনেমায় পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পুলিশের উচিৎ আগে নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রাখা। একই সাথে তারা মনে করেন, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে পুলিশেরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সাহস পেয়ে থাকেন। পিলিশের এই লাগামহীন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড রুখতে সরকারকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/০৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ