২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এই হত্যার দায়ে ছাত্রলীগের ২০ নেতা-কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এরপর খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। দুটি ঘটনাই শিক্ষাঙ্গন তো বটেই, এর বাইরেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চৈতন্যোদয় ঘটেছে বলে মনে হয় না।
এদিকে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার প্রতিপালন বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ নিহাদকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন সেখানকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা হুমকি দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হলে ছাত্রলীগ করতে হবে। বাড়াবাড়ি করলে আবরারের মতো মরতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ নিহাদ অভিযোগ করেন, তার ওপর রোববার রাত দেড়টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতন চলে। বঙ্গবন্ধু হলের একাত্তর ব্লকে ডেকে নিয়ে তাকে যারা মারধর করেন তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। ছাত্রলীগ না করায় তাকে মারা হয় বলে দাবি নিহাদের।
শিক্ষার্থী নির্যাতনের এই ঘটনায় উত্তেজনা চলছে ক্যাম্পাসে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, রোববার রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ওয়ালিদ নিহাদ তার এক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে ৩২৪ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যান এবং ছাত্রলীগ করার জন্য চাপ দেন। তিনি রাজি না হলে তাকে চড়থাপ্পড় ও ঘুষি মারা হয়। এতে ওই শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। মারধর করার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তার হাতে একটি রামদা দেন এবং তাকে বলতে বাধ্য করেন যে ‘২০২৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে,…আওয়ামী লীগ দেশে থাকতে পারবে না ইত্যাদি বলানো হয়।’ পরে এটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার প্রতিপালন বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ নিহাদকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন সেখানকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা হুমকি দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হলে ছাত্রলীগ করতে হবে। বাড়াবাড়ি করলে আবরারের মতো মরতে হবে।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কাণ্ড এটাই প্রথম নয়। গত তিন বছরে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী তাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। গত ডিসেম্বরে দোলনচাঁপা হলে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গেও তাঁরা দুর্ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রক্টরের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করলেও মামলা হয়নি। মারধরের শিকার নিহাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন মামলা করল না?
এদিকে মানবাধিকারবিষয়ক শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)’ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলগুলোতে বিগত পাঁচ মাসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া ৩ জন সাংবাদিক ও দুইজন ফটো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় নির্যাতকের ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ছয়টি হলে ১৮ জন শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে স্যার এ এফ রহমান হলে সবচেয়ে বেশি সাতজনকে নির্যাতন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, মাস্টারদা সূর্য সেন ও বিজয় একাত্তর হলে নির্যাতন করা হয় তিনজন করে।
রোকেয়া হল ও জগন্নাথ হলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতাকে আমরা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখি। নাগরিকরা কোনো নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক দণ্ডের শিকার হবে না- এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তেমনি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা যে কোনো নির্যাতন, নিপীড়ন কিংবা সহিংসতার শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি আবাসিক হলগুলোর অতিথি কক্ষে। যা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারকেও নীরবে হরণ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এরপরও ছাত্রলীগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে না বলে হুমকি দেওয়া তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
তারা বলেন, ছাত্রলীগ নামধারী যারা সহপাঠীকে মারধর করেছেন এবং হত্যার হুমকি দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আমরা জানি, অপরাধের বিচার হলে ও অপরাধীরা শাস্তি পেলে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা এতটাই বেপরোয়া যে শাস্তিও তাদের দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছে না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কীভাবে এর দায় এড়াবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রূপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৭
আপনার মতামত জানানঃ