চারশ বছরের পুরনো ঢাকা এখন বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য ও অনিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জরিপ ও গবেষণা সংস্থা দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপে নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্বের নগরীগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এখনও তলানিতেই রয়েছে। আর একটি শহর অনিরাপদ হওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ একটি সরকার না থাকাকে দায়ী করেছে প্রতিবেদন।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত দি ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘সেফ সিটি ইনডেক্সে’ এবার ৬০টি নগরীর মধ্যে ঢাকার স্থান হয়েছে ৫৪ নম্বরে।
ইকোনমিস্ট গ্রুপের এই গবেষণা সংস্থার এই সূচকে ২০১৯ সালে ঢাকা ছিল ৫৬ নম্বরে, অর্থাৎ দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে দুই বছরে।
অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পরিবেশগত সুরক্ষা, ডিজিটাল পরিস্থিতিসহ ৭৬টি নিয়ামকের ভিত্তিতে এই তালিকার ক্রম সাজানো হয়েছে। এতে ঢাকার স্কোর দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৪। ৮২ দশমিক ৪ নম্বর নিয়ে তালিকায় শীর্ষে স্থান পেয়েছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। আর তালিকার সবচেয়ে নিচে থাকা মিয়ানমারের ইয়াংগুন নগরীর নম্বর ৩৯ দশমিক ৫।
পরিবেশ সুরক্ষার দিকে থেকে ঢাকা কিছুটা এগিয়েছে, এই নিয়ামকের ভিত্তিতে ঢাকার ক্রম ৪৭। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তার দিক থেকে পেছনে ৫৬ নম্বরে। স্বাস্থ্য সেবা, অবকাঠামো ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান যথাক্রমে ৫২, ৫৫ ও ৫৪ ক্রমতে। অন্যদিকে বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে থাকা শহরের তালিকায় ঢাকা ‘চতুর্থ’।
দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকার পেছনে রয়েছে করাচি। ভারতের মুম্বাইয়ের অবস্থান ৫০ নম্বরে, তার দুই ধাপ সামনে আছে দেশটির রাজধানী শহর নয়াদিল্লি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কানাডার টরোন্টো। সামনের সারিতে আরও রয়েছে টোকিও, সিঙ্গাপুর, ওসাকা। ইআইইউর চতুর্থ বার করা এই তালিকায় আগের মতোই শীর্ষ ১০ এ আছে আমস্টারডাম, মেলবোর্ন ও সিডনি এবং শহরগুলোর স্কোরের পার্থক্য সামান্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা স্পষ্ট যে আয় ও জবাবদিহিতা ভালো স্কোর গড়ার মূল নির্ণায়ক। মানব উন্নয়ন সূচকে যে সব নগরীর স্কোর বেশি, সেটাও তালিকায় উপরের দিকে তুলতে সহায়তা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, কার্য কারণ দিয়েই সব হয় না। আয় বৃদ্ধি বিনিয়োগ বাড়াতে পারে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক পরিবেশ কতটা নিশ্চিত হয়েছে, তার উপর। এক কথায় বলতে গেলে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার মধ্যে একটি সম্পর্ক টানা যায়। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের স্কোর আর আমাদের মানব উন্নয়নের স্কোর মিলে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি শহরকে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ একটি সরকার থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের তুলনায় ঢাকার দুই ধাপ অগ্রগতির মানে এই নয় যে ঢাকা শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার উন্নয়ন ঘটেছে। বরং এর উল্টোটাই ঘটেছে। ঢাকা শহরের পরিবেশগত নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, যানজট ও আবাসন সমস্যা নিরসনসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তার বড় কারণ ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
দুঃখজনক বিষয় হলো, রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থাই এ জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট।
বস্তুত এ শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যে যেখানে পারছে যেকোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বিশিষ্টতা হারাচ্ছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যানজটের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা।
তারা বলেন, ঢাকায় সুউচ্চ অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। উড়াল সড়কও হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার জীবনযাপন সুগম ও সুন্দর হয়েছে বলে মনে হয় না। এ নগরীতে পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের ফলে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকর বায়ু গ্রহণ করেই এ শহরে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ভারী ধাতুর দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতিমাত্রায় শব্দদূষণ নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলার ফলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।
বস্তুত এ শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যে যেখানে পারছে যেকোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বিশিষ্টতা হারাচ্ছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যানজটের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা।
তারা বলেন, যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, খাদ্যে ভেজাল, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এ শহরে নেই পয়োনিষ্কাষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। বাতাসে সিসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস ও পানির সমস্যা বহুদিন ধরে চলে আসছে। গণপরিবহন বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তা নেই। উচ্চ খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া গেলেও তার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। গুটিকতক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা এখানে অনুপস্থিত। মাঠ ও পার্কগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে।
এখানে উন্নয়নের নামে বেশুমার অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই, তবে সে অনুযায়ী উন্নয়ন দেখা যায় না। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার এই করুণ দশা। দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আর ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার কারণেই কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যান্য শহরকেও পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। সুষম উন্নয়ন করতে হবে গ্রামেও। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ