মুন্সিগঞ্জের নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে আটটি স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এ আবিষ্কারকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলা হচ্ছে। এবারের আবিষ্কারসহ নাটেশ্বরে পঞ্চমবারের মতো অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ পাওয়া গেল।
খননকাজ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আরও তিনটি স্তূপ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন ও ঐতিহ্য অন্বেষণের উৎখননের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ এ ধর্মচক্র আবিষ্কৃত হলো।
নবম ধাপে ছয় মাসের উৎখননে আবিষ্কৃত এই নিদর্শন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে বিরল। এটি প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ও দেশের প্রত্নক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি গবেষণা ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৌদ্ধ ধর্মে একক পুজোনীয় হিসেবে প্রাচীন কাল থেকে ধর্মচক্র বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়।
সদ্য আবিষ্কৃত এ পঞ্চম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্টাকোনাকৃতি স্তূপের দেয়ালের গাঁথুনি এখনো অপূর্ব মসৃণ। দেখে যেন মনে হয় বর্তমানের আধুনিক যুগের সিরামিকের তৈরী ইটের গাঁথুনি।
গতকাল অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন সংবাদ সম্মেলনে এ আবিষ্কারের কথা জানিয়ে বলা হয়, ২০১৩-১৪ সাল থেকে নাটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু করা হয়। এর মধ্যে উৎখননের মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে।
ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০-১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মভূমি বিক্রমপুরের নাটেশ্বর দেউলে সম্প্রতি আবিষ্কৃত প্রতীকী স্থাপত্যগুলো দেখে মনে হয়, প্রায় ১ হাজার ১০০ বছর আগে বিক্রমপুরে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করেছিল।
তিনি জানান, হয়তো সেই কারণে তিব্বতের তৎকালীন রাজা বৌদ্ধধর্ম রক্ষায় পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যান।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগে যে অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ পেয়েছিলাম, সেগুলোতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের দেহাবশেষ সমাহিত করা হতো। ওগুলোকে মন্দিরও বলা যায়।
প্রতিটি স্থাপনায় দুটি স্তূপ একসঙ্গে থাকত। একটি ‘আদি পর্যায়’, অন্যটি ‘পরবর্তী পর্যায়’। আগে খননের মাধ্যমে ‘পরবর্তী পর্যায়’ পাওয়া গিয়েছিল।
এবারের আবিষ্কার অন্য সময়ের চেয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবার আদি পর্যায়টা বেশি পাওয়া গেছে। এখানে আট স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র পাওয়া গেছে। এই ধর্মচক্রকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
এর মাধ্যমে বৌদ্ধ দর্শনের অষ্টাঙ্গিক মার্গ—সৎদৃষ্টি, সৎসংকল্প, সৎবাক্য, সৎকর্ম, সৎজীবিকা, সৎচিন্তা, সঠিক চৈতন্য ও সৎধ্যান প্রতীকীরূপে প্রতিফলিত করেছে।
নিরেট ভিত্তিভূমিতে আট স্পোকযুক্ত ধর্মচক্রের ওপর হাজার বছরের প্রাচীন হলঘর বা মণ্ডপসহ অষ্টকোনাকৃতির স্তূপের উপস্থিতি এর আগে বাংলাদেশ কেন, ভারতবর্ষের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি বলে জানান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নাটেশ্বর দেউলে আবিষ্কৃত কেন্দ্রীয় অষ্টকোনাকৃতির মন্দির, বর্গাকৃতির স্তূপ, একাধিক অষ্টকোনাকৃতি স্তূপ, স্তূপের স্মারক কক্ষে বর্গাকার, অষ্টকোনা ও গোলাকার (শূন্য) প্রতীকী স্থাপত্য, আট স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র—সবই বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্রের প্রতীকী রূপ। নাটেশ্বর দেউলে প্রায় সব স্থাপত্যে প্রতীকীরূপে বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন ফুটিয়ে তোলার এমন নজির আর কোথাও নেই।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে নতুন আবিষ্কৃত নিদর্শন ঘুরে দেখেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর। এ সময় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূহ-উল-আলমসহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত, টঙ্গিবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা তানজিন, অতীশ দীপঙ্কর কমপ্লেক্সের অধ্যক্ষ করুণা থেরো ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান জগলুল হাওলাদার উপস্থিত ছিলেন। পরে তাঁরা সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
নূহ-উল-আলম বলেন, নাটেশ্বর দেউলের এবারের আবিষ্কার বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবার খননের প্রথম তিন মাস নাটেশ্বর দেউল উৎখননে উপরিপৃষ্ঠ থেকে চার-পাঁচ মিটার পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো প্রত্নবস্তুর আবিষ্কার হচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মিটার গভীরতার পর প্রাচীন ইটের দেয়ালের অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হতে থাকে। সীমানাপ্রাচীর, স্তূপ হলঘর, স্তূপের ইটের দেয়ালও আবিষ্কৃত হতে থাকে।
এ রকম আরও তিনটি স্তূপ আবিষ্কৃত হবে, এমন ধারণার কথা উল্লেখ করে রতন চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, পুরোটা আবিষ্কৃত হলে ওগুলো সংরক্ষণের কাজ শুরু হবে। খননকাজ ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ। এ কাজে অভিজ্ঞ লোকবলের প্রয়োজন। কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর লাগবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এখানে দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে দেশ–বিদেশের অনেক দর্শনার্থী আসবেন বলে আশা করছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ