সর্বব্যাপী দুর্নীতির কারণে ব্যাহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। গাড়ি নিবন্ধনে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন (ট্যাক্সপেয়ারস আইডেনটিফিকেশন নাম্বার) জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিআরটিএর সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন করতে গিয়ে দেখা যায়, জাল টিআইএন ব্যবহার করে প্রায় পাঁচ লাখ গাড়ি নিবন্ধন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়হীনতাকে পুঁজি করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এমন অপকর্ম করেছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার ফল এটি। এতে বছরের পর বছর বড় অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে বিআরটিএ থেকে এক হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে। গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ার। এর মধ্যে ৮৯১টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহার করা টিআইএন যাচাই করে দেখা যায়, ১২৬টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে জাল টিআইএন (ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেনটিফিকেশন নাম্বার বা করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) ব্যবহার করা হয়েছে। এতে টনক নড়ে উভয় সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের। এরপর বিআরটিএ-র সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জাল টিআইএন-এর তৎপরতা বন্ধে টিআইএন সার্ভারের সঙ্গে বিআরটিএ সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের কাজ শুরু হয়।
সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন উপলক্ষ্যে এনবিআর-এর সম্মেলন কক্ষে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিআরটিএ-র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এনবিআর-এর আইটি অনুবিভাগের উপস্থাপনায় বলা হয়, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের পর বিআরটিএ-র সফটওয়্যারে ১২ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭২টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের বিপরীতে টিআইএন পাওয়া যায়। এর মধ্যে আট লাখ ৪৩টি গাড়ির টিআইএন সঠিক। বাকি চার লাখ ৮৫ হাজার ৫২৯টি টিআইএন সঠিক নয়। অর্থাৎ, জাল টিআইএন-এ এসব গাড়ির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিআরটিএ-র চেয়ারম্যান নূর বলেন, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন করার পর গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে। এগুলো সমাধানে এনবিআর ও বিআরটিএ যৌথভাবে কাজ করছে। আগামীতে নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয় তথ্য দুই সংস্থাই ভেরিফাই করতে পারে। তিনিও আরও বলেন, বিআরটিএ-র সিস্টেম আপগ্রেড করা হচ্ছে। ফলে কারও একাধিক গাড়ি থাকলে আয়কর আইন অনুযায়ী কর আদায় করা যাবে। এ ছাড়া ভুয়া বা জাল টিআইএন-এ গাড়ি রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, জাল টিআইএন-এ দামি গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। গাড়ি আমদানিকারক থেকে শুরু করে বিআরটিএ-র কর্মকর্তা-দালালদের সমন্বয়ে সৃষ্ট এ চক্রের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলে। ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের ফলে এখন আর জাল টিআইএন-এ গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না।
এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভুয়া টিআইএন ব্যবহারকারীদের এখন খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যেহেতু দুই সংস্থার সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন হয়ে গেছে, তাই গাড়ি রেজিস্ট্রেশন নবায়নের সময় ভুয়া টিআইএনধারীরা ধরা পড়বেই। তখন নবায়নে তাদের সঠিক টিআইএন দিতে হবে। আর এনবিআর তখন ওইসব গাড়ির মালিকের কর ফাইল পুনরুন্মোচন করবে।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি কোনো সমাধান নয়। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা যাবে না বলা সমাধানযোগ্য নয়। পরবর্তী সময়ে তারা গাড়ি পুনর্নিবন্ধন করবে বা গাড়ির হাতবদল ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? জাল টিআইএন দিয়ে নিবন্ধন নেয়া গাড়ি চিহ্নিত করা হয়েছে বলে খবর মিলছে। গাড়ির নম্বর ধরে এর গ্রহীতাকে চিহ্নিত করা কঠিন কোনো কাজ নয়। এজন্য শুধু সদিচ্ছা জরুরি।
আয়কর অধ্যাদেশে জাল টিআইএন ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর ওপর আর্থিক জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আয়কর আইন অনুযায়ী, জাল টিআইএন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে সেবা প্রদানকালে টিআইএন সনদ যাচাই না করলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে আয়কর বিভাগ। ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যক্তি জাল টিআইএন ব্যবহার করে বা অন্যের টিআইএন ব্যবহার করে, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাল টিআইএন দিয়ে গাড়ি রেজিস্ট্রেশন নেওয়ার সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারিয়েছে। এটি দেখার মূল দায়িত্ব বিআরটিএ-র ছিল। দেরিতে হলেও বিষয়টি ধরা পড়েছে। এখন উচিত হবে, যারা জাল টিআইএন দিয়ে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অনিয়ম করতে না পারে।
তিনি আরও বলেন, একাধিক গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে এনবিআর ২০১৫ সালে অতিরিক্ত কর আদায়ে আইন করলেও বিআরটিএ সেটা আদায় করতে পারেনি কেন, সে বিষয়ে তৎকালীন কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। এখানে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। বিআরটিএ সরকারি সংস্থা হিসাবে অন্য একটি সংস্থার নির্দেশনা অমান্য করতে পারে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাল টিআইএন-এর ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত যথাযথ আইনের আওতায় আনা জরুরি। উল্লিখিত দুর্নীতির কারণে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। যাদের দায়িত্বহীনতায় এমন দুর্নীতি হয়েছে, তাদের সবাইকে দ্রুত যথাযথ আইনের আওতায় আনা জরুরি। দুর্নীতি সরকারের বড় বড় অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। দুর্নীতি রোধে সরকারকে যথার্থই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬৫৩
আপনার মতামত জানানঃ