ডাইনোসরের প্রজনন নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের আগ্রহ বহুদিনের। কিন্তু এদের যৌন অঙ্গ কখনোই জীবাশ্মে পরিষ্কারভাবে সংরক্ষিত থাকে না, বিশেষ করে নরম টিস্যুর মতো জিনিসপত্র। তবু কিছু অসাধারণ জীবাশ্ম, আধুনিক পশুদের তুলনা, এবং নির্দিষ্ট আচরণের চিহ্ন থেকে বিজ্ঞানীরা আজ ডাইনোসরের প্রজনন নিয়ে বেশ কিছু ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, পাখি ও কুমির—এই দুই প্রাণী-সম্পর্কিত দলের মাধ্যমেই ডাইনোসরের যৌন আচরণ কিছুটা অনুধাবন করা সম্ভব। এই দুই দলের মতোই অনেক ডাইনোসরের শরীরে ক্লোয়াকা নামক একটি বহুমুখী অঙ্গ ছিল, যার মাধ্যমে মল, মূত্র এবং বীর্য বা ডিম নির্গত হতো। একধরনের ডাইনোসর সিটাকোসরাসের একটি জীবাশ্মে বিজ্ঞানীরা এই ক্লোয়াকার বাহ্যিক গঠন আবিষ্কার করেন, যা আজকের কুমিরের মতোই মেলানিনযুক্ত রঙিন লিপে ঢাকা ছিল এবং সম্ভবত যৌন আকর্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো। এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে ডাইনোসরদের মধ্যে দেহের নির্দিষ্ট অংশ প্রদর্শনের মাধ্যমে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা ছিল।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, কিছু ডাইনোসরের দৃশ্যমান লিঙ্গ ছিল, যেটি ক্লোয়াকার মধ্যেই সংরক্ষিত থাকত এবং প্রয়োজনের সময় বাইরে বের হতো, যেমনটা আমরা কুমিরের ক্ষেত্রে দেখি। যদিও জীবাশ্মে এ ধরনের অঙ্গ কখনোই পাওয়া যায়নি, কারণ মাংসল, নরম অংশ সহজে সংরক্ষিত হয় না। তবে এর স্বপক্ষে কিছু পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে। যেমন, সিটাকোসরাসের ক্লোয়াকার আশেপাশে গাঢ় বর্ণের রঙ এবং নির্দিষ্ট গঠন, যা যৌন আচরণের ইঙ্গিত বহন করে। আবার কিছু ডাইনোসরের শিং, গলা ঘিরে ফ্রিল, বা মাথার ওপরের ঝুঁটি—সবই এক ধরনের যৌন নির্বাচনের অংশ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এসব গঠন কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা গেছে, ছোটদের মধ্যে নয়, যা আরও একবার প্রমাণ করে যে এগুলো যৌন যৌগিকতার ইঙ্গিতবাহী।
ডাইনোসরের যৌন আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো কিছু থেরোপড ডাইনোসরের আঁচড় দেওয়ার চিহ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে পাওয়া এমন ৫০টির বেশি দাগ, যেগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এগুলো ছিল একধরনের প্রেম-প্রদর্শনের অংশ। পাখিরা যেমন সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে নাচ করে বা মাটি খুঁড়ে প্রদর্শন করে, তেমনি ডাইনোসররাও তাদের সঙ্গীকে প্রভাবিত করতে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে মাটি আঁচড় দিত। এমনকি একই জায়গায় একাধিক আঁচড়ের স্তর দেখে ধারণা করা হয়, একাধিক পুরুষ ডাইনোসর সেখানে এসে প্রেম-প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা করত।
আরও একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার হলো গোবি মরুভূমিতে পাওয়া দুইটি ওভির্যাপটর ডাইনোসরের যুগল জীবাশ্ম। তাদের মরদেহ এমনভাবে অবস্থান করছিল, যা দেখে অনেকেই মনে করেন তারা সঙ্গমরত অবস্থায় ছিল। যদিও এটি প্রমাণ করা কঠিন, তবে এমন মিল পাওয়া একান্তই বিরল এবং এটি ডাইনোসরের যৌন আচরণের একটি জীবন্ত ছবি তুলে ধরে। কিছু কিছু ডাইনোসরের শক্তিশালী হাত, যেমন টিরানোসরাসের খর্বকায় অথচ বলিষ্ঠ বাহু, সম্ভবত সঙ্গীকে ধরে রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো, যেটা আজকের অনেক প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। এমনকি গবেষণায় সেই হাতের হাড়ে চাপের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা প্রজননকালে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফল হতে পারে।
সব মিলিয়ে, যদিও ডাইনোসরের প্রজননের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, কিন্তু অসংখ্য পরোক্ষ চিহ্ন ও আধুনিক প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে বোঝা যায়—তাদের যৌন আচরণ ছিল চমকপ্রদ, বৈচিত্র্যময় ও সম্ভবত প্রদর্শনভিত্তিক। তারা শারীরিক গঠনের সাহায্যে সঙ্গীকে আকর্ষণ করত, নিদিষ্ট নাচের মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করত এবং ক্লোয়াকার সাহায্যে যৌন মিলনে অংশ নিত। ভবিষ্যতে জীবাশ্ম প্রযুক্তির আরও উন্নয়ন ঘটলে হয়তো একদিন আমরা ডাইনোসরের যৌনজীবনকে আরও গভীরভাবে জানতে পারব, এমনকি হয়তো তাদের প্রেমও একদিন রঙিন কল্পনার বিষয় নয়, বরং বাস্তব ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে।
আপনার মতামত জানানঃ