বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ইস্যু সামনে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে গঙ্গার পানি বণ্টন, বাণিজ্য সম্পর্ক, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং ত্রিপক্ষীয় কূটনীতি। এসব প্রসঙ্গেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল তার অবস্থান তুলে ধরেছেন। তার মন্তব্যগুলো শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিকেই ইঙ্গিত করে না, বরং এতে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বড় বার্তাও লুকিয়ে আছে।
রণধীর জয়সওয়াল স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনায় প্রস্তুত, তবে সেটি হতে হবে ‘অনুকূল পরিবেশে’। এখানে ‘অনুকূল পরিবেশ’-এর উল্লেখটি গুরুত্বপূর্ণ, যা নেপথ্যে কিছু অসন্তোষ বা উদ্বেগের ইঙ্গিত বহন করে। গঙ্গাসহ ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) থাকলেও কার্যকর সিদ্ধান্তের অভাব এবং চুক্তির নবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। ভারত বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, তবে তাদের মতে, আলোচনার সঠিক পরিবেশ এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।
বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও রণধীর জয়সওয়াল কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে ভারতের যে সংশোধিত বাণিজ্যিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, তা দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফল। ভারত মনে করছে, বহুদিন ঝুলে থাকা বাণিজ্যিক বিষয়গুলোর সমাধান চাইলেও বাংলাদেশ সেই উদ্যোগে ধীর গতিতে এগোচ্ছে। সচিব পর্যায়ে একাধিক গঠনমূলক বৈঠক হলেও বাস্তব অগ্রগতি নিয়ে ভারতের কিছু অনুযোগ রয়েছে।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির ভাঙা। ভারত সরকারের মতে, এটি শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের একটি উদাহরণ নয়, বরং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বারবার ঘটতে থাকা ধর্মীয় সহিংসতার একটি ধারাবাহিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। রণধীর বলেন, সরকার উল্টো ‘অবৈধ জমি’ ব্যবহারের অজুহাতে মন্দির ভাঙার অনুমতি দিয়েছে, যা ভারতের জন্য ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিন্তু তারাই এখন সুরক্ষার বদলে হিন্দুদের উপাসনালয় ধ্বংসের অনুমোদন দিচ্ছে — এটাই ভারতের মূল অভিযোগ।
এই মন্তব্য শুধু কূটনৈতিক স্তরে নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বারবার দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দুদের নিরাপত্তা ও তাদের অধিকারকে সামনে এনে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেয়। বাংলাদেশের মন্দির ধ্বংস সংক্রান্ত ঘটনাগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তাবাহকের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে এই ইস্যুতে রণধীরের বক্তব্য শুধু কূটনৈতিক নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
এর পাশাপাশি চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে ভারত প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের মতে, তারা আশপাশের অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে ‘নিবিড় নজর’ রাখছে। অর্থাৎ, ভারত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কৌশলগত প্রবেশকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে, বিশেষ করে যখন তাতে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যুক্ত থাকে। রণধীরের বক্তব্যে একদিকে যেমন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে, তেমনি এক ধরনের অস্বস্তিও ফুটে উঠেছে। চীন যদি বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় এবং পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাহলে তা ভারতের নিরাপত্তা ও স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলবে — এই বার্তা ভারত স্পষ্টভাবেই দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বৈঠকে চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলে দক্ষিণ এশিয়ার সহযোগিতার প্রসার নিয়ে যে আলোচনা করেছে, তা ভারতের কাছে একটি কৌশলগত হুমকি হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। ভারত সম্ভবত সন্দেহ করছে, চীন এই অঞ্চলে একটি বিকল্প জোট গঠনের চেষ্টা করছে, যাতে ভারতকে কৌশলগতভাবে একঘরে করে রাখা যায়। আর এই ভাবনা থেকেই ভারত সতর্ক এবং প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে দেখছে।
সবমিলিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্য শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তুতির ইঙ্গিত নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ধরে রাখার কৌশল, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা এবং চীনের ভূ-রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ। ভারত এখন চায় বাংলাদেশ নিজেদের ভূমিকা আরও ভারসাম্যপূর্ণ করুক — যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ‘অনুকূল পরিবেশে’ এগিয়ে যায়, এবং তৃতীয় পক্ষের (বিশেষত চীনের) প্রভাব সীমিত রাখা যায়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের সঙ্গে সীমান্ত, নদীর পানি, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বাস্তবতা অস্বীকার করা অসম্ভব। দুই পরাশক্তির মাঝে বাংলাদেশ কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখবে — তা নির্ধারণ করে দেবে আগামী দিনের কূটনৈতিক দৃশ্যপট।
আপনার মতামত জানানঃ