ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক সংঘর্ষ আজ শুধু দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বিভাজন ও একাকীত্বের প্রকাশ। গাজার উপর ইসরাইলের নৃশংস আগ্রাসন, সিরিয়ার সংকট, ইয়েমেন যুদ্ধ — এসব সংকটের মধ্যে মুসলিম দেশগুলো যে এককভাবে কার্যকর কোনো ঐক্য বা সমাধান করতে পারেনি, তা গত শতাব্দীর ইতিহাসই প্রমাণ করে।
১৯১৬ সালের সাইকস-পিকো চুক্তি, যা মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশকে ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে ভাগ করে দেয়, আজও এই অঞ্চলের বিভাজনের মূলে রয়েছে। এরপর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন বিভাজনের পর থেকে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন মুসলিম বিশ্বে এক যুগান্তকারী সংকট তৈরি করেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম দেশগুলো সেই সংকট মোকাবিলায় একক চরম ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি।
ইরান এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, এমনকি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে উত্তরে ফের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তবে এ দ্বিপাক্ষিক সংঘাতের পেছনে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক নাটক চলছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান শক্তি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও তুরস্কের মধ্যে এখনো বিভাজন এবং স্বার্থবিবাদ বিরাজ করছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেও কার্যকর কোনো ঐক্যের উদ্যোগ নিতে পারেননি। অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইতোমধ্যেই ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে মুসলিম দেশগুলোর এই বিভাজন ও একতার অভাব রাশিয়া ও চীনকেও কার্যকর সমর্থন দিতে বাধা দিচ্ছে। যদিও চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে, তারা সরাসরি ইরানের পাশে দাঁড়ায়নি। এছাড়া পশ্চিমা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের সময় তাদের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি দ্বৈত মানদণ্ডের প্রমাণ।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়া দুই বার ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানালেও তারা সরাসরি ইরানের পক্ষে কূটনৈতিক বা সামরিক কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ চীন ও রাশিয়ার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল।
চীন মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে বড় অংশীদার হওয়ার কারণে বিশেষত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI) ও তেল আমদানিতে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা তার জন্য অপরিহার্য। তাই চীন মধ্যপ্রাচ্যের জোটগুলোর মধ্যে কোন একপক্ষের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয় না। চীন অবশ্যই মুসলিম বিশ্বের বড় জনগোষ্ঠী (বিশেষত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান) সহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে, কিন্তু সামরিক হস্তক্ষেপ বা শক্তি প্রয়োগে তারা দ্বিধাবোধ করে। তারা প্রধানত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট মেটাতে চেষ্টা করছে।
রাশিয়া সিরিয়ায় বরাবর ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানকে সমর্থন দিয়ে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বে রাশিয়া সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক অবস্থান দুর্বল, তাই তারা সযত্নে মধ্যপ্রাচ্যের ঝামেলা বাড়াতে চায় না। রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের নিন্দা দিলেও বাস্তবে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
যদিও চীন ও রাশিয়া তাদের কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ইরানের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে পারতো, কিন্তু তারা এড়িয়ে যাচ্ছে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি। সামরিক সহায়তা, অস্ত্র সরবরাহ বা মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির সরাসরি ব্যবহার থেকে তারা বিরত রয়েছে। তাদের জন্য ইরান একটি কৌশলগত বন্ধু হলেও, চীন ও রাশিয়ার বৃহত্তর আন্তর্জাতিক স্বার্থ, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক এবং নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সংকট তাদের সীমিত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।
মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের অভাব শুধু সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সময়ও দেখা গিয়েছিল, মুসলিম দেশগুলো একত্রিত হয়ে কোন কার্যকর প্রতিবাদ করতে পারেনি। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ও সিরিয়ার সংকটেও একই ছবি। ফলে ফিলিস্তিনের ইস্যুতে কোনো অভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি হয়নি। কেউ হামাসকে সন্ত্রাসী বলেছে, কেউ মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে, কিন্তু সম্মিলিত রাজনীতি গড়ে ওঠেনি।
ইরানের রাজনৈতিক একঘরত্বের পেছনে সুন্নি-শিয়া বৈরিতা, পারস্য-আরব সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত দ্বন্দ্ব কাজ করছে। কিন্তু ইসরাইল যখন তাদের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন ইরানের প্রতিরোধ একক হলেও বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের এই বিভাজন, একতার অভাব এবং রাজনৈতিক অসহায়তা নতুন কিছু নয়। এটি বহু যুগ ধরে চলমান সমস্যা, যা ২০তম শতাব্দীর ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে আজকের বিশ্ব রাজনীতির দ্বৈত মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। আজও মুসলিম দেশগুলো এক কার্যকর, সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষম ও ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গঠন করতে পারেনি। ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) এর কার্যকর ভূমিকা সীমাবদ্ধ, অধিকাংশ সময় কেবল বিবৃতিমূলক অবস্থান গ্রহণ করে।
মুসলিম বিশ্ব যদি সত্যিই একত্রিত হতে চায়, তবে তাদের বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা শক্তিশালী করতে হবে। একটি কার্যকর ও সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষম মুসলিম কূটনৈতিক জোট গড়ে তুলতে হবে, যা শুধু বিবৃতিমূলক নয়, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও কাতার একত্রে একটি বিকল্প কৌশলগত ও অর্থনৈতিক জোট তৈরি করতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত প্রতিরোধে কাজ করবে।
চীন ও রাশিয়া অবশ্যই এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে, যদি তারা তাদের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের জন্য কাজে লাগায়। তবে তারা এড়িয়ে যাবেন না সরাসরি সংঘাতে, কারণ তাদের স্বার্থ বিপরীত হতে পারে।
ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ শুধু দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিশ্ব রাজনীতির জটিলতা, মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের অভাব ও আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বৈত মানদণ্ডের একটি মূর্ত প্রতিফলন। মুসলিম উম্মাহর সামনে এখন সময় এসেছে এই অনৈক্য, বিভাজন ও রাজনৈতিক নীরবতার বিরুদ্ধে এককথায় প্রতিবাদ করার এবং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নেওয়ার। নতুবা মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্ব শান্তির জন্য এই সংকটের মারাত্মক প্রভাব চলতে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ