ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সোমবার ভোররাতে ইসরায়েলের তেলআভিভ ও বন্দরের শহর হাইফায় আঘাত হানে, যা বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয় এবং এই সপ্তাহে কানাডায় অনুষ্ঠিত জি৭ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে যে, দীর্ঘদিনের দুই শত্রুর এই লড়াই আরও বড় আঞ্চলিক সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে।
সর্বশেষ ইরানি হামলায় অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি সেবা, ফলে শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল অন্তত ১৮ জনে। এছাড়া রাতভর হামলায় আরও অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছে। এই হামলা ছিল ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, যা তারা চালিয়েছে ইসরায়েলের আগাম হামলার জবাবে, যেখানে ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল।
হাইফায় উদ্ধার ও অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছে জরুরি কর্তৃপক্ষ, যেখানে প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছে। গণমাধ্যম জানিয়েছে, বন্দরের কাছে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লেগে গেছে।
তেলআভিভের আকাশে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র দেখা গেছে এবং সেখানে ও জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। তেলআভিভের এক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়েকটি আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, বিস্ফোরণের প্রভাবে আশপাশের হোটেল ও ঘরবাড়ির জানালাও ভেঙে গেছে। এই এলাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস শাখা থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, ভবনটি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ আহত হয়নি।
৩১ বছর বয়সী এক রন্ধনশিল্পী বলেন, “যেমনটা হয়, আমরা রাস্তার ওপারে যে আশ্রয়কেন্দ্র আছে, সেখানে ঢুকে পড়ি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজাটা উড়ে যায়। কয়েকজন রক্তাক্ত অবস্থায় ভিতরে আসে। পরে আমরা যখন বাড়িতে ফিরে যাই, দেখি অনেক কিছুই আর অবশিষ্ট নেই… দেয়াল ধসে গেছে, কাঁচ নেই, জানালা উড়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটা হচ্ছে অনিশ্চয়তা। এটা হয়তো অনেকদিন চলবে, হয়তো আরও খারাপ হবে, হয়তো ভালোও হতে পারে। কিন্তু অনিশ্চয়তাই সবচেয়ে ভয়াবহ।”
ভোররাতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তেলআভিভের জনপ্রিয় শূক হাকারমেল বাজারের কাছে আঘাত হানে, যেখানে সাধারণত প্রচুর মানুষ তাজা ফলমূল, সবজি কেনে এবং বার ও রেস্তোরাঁয় যায়। পাশের পেতাহ তিকভা শহরের এক আবাসিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বিৎনি ব্রাক নামে একটি অতি-ধর্মীয় ইহুদি শহরের একটি স্কুলেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
‘নতুন পদ্ধতি’
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস জানিয়েছে, তারা এই হামলায় একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যাতে ইসরায়েলের একাধিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের মাঝেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয়েছে।
তারা বলেছে, “এই অভিযানে যে উপায় ও সক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির পূর্ণ সমর্থন এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দখলকৃত ভূখণ্ডে লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই হামলার বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তারা বারবার বলেছে, তাদের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শতভাগ কার্যকর নয় এবং সামনে আরও কঠিন সময় আসছে।
ইরানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ২২৪ জনে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক বলে জানিয়েছে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সোমবার সকালে জানিয়েছে, তারা আবার ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ও সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে।
নেতারা একত্রিত
জি৭ নেতারা রবিবার কানাডার রকিস পর্বতমালায় জড়ো হচ্ছেন, যেখানে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত সম্মেলনের শীর্ষ এজেন্ডা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ জানিয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা, সংঘাত যেন না বাড়ে তা নিশ্চিত করা এবং কূটনীতির পথ খোলা রাখা।
তিনি বলেন, “এই বিষয়টি জি৭ সম্মেলনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।”
রবিবার সম্মেলনে রওনা হওয়ার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কী করছেন। তিনি বলেন, “আমি আশা করি একটা চুক্তি হবে। আমি মনে করি, এখনই সময় চুক্তির।” তিনি আরও বলেন, “কখনও কখনও লড়াই করেই সমাধান বের করতে হয়।”
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান সোমবার পার্লামেন্টে বলেন, তার দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না, তবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ও গবেষণার অধিকার তারা বজায় রাখবে।
তেল ও শেয়ারবাজার
ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম সোমবার এশিয়ার বাজারে ৭৪.৯৪ ডলারে পৌঁছায়, যা আগের তুলনায় ০.৭০ ডলার বা ১ শতাংশ বেশি। সেশনের শুরুতে দাম ৪ ডলার পর্যন্ত বেড়েছিল। তবে তেল নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও, শেয়ারবাজার ও মুদ্রা বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি।
বলাস্ট রক প্রাইভেট ওয়েলথের সিনিয়র উপদেষ্টা জিম ক্যারল বলেন, “এটা এখন মূলত তেলের ব্যাপার, শেয়ারের নয়। শেয়ারবাজার আপাতত স্থিতিশীল আছে।”
ট্রাম্প খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনায় ভেটো দেন
ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হলে, ট্রাম্প তা বাতিল করে দেন।
এই রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, “অনেক ভুয়া রিপোর্ট আছে, যেসব কথোপকথন আদৌ হয়নি, আমি এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা যা করা দরকার, তাই করি।”
শুক্রবার ইসরায়েল হঠাৎ হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক নেতৃত্বের শীর্ষ স্তরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা জানিয়েছে, এই অভিযান আরও তীব্র হবে।
ইরান পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে, “আমরা নরকের দরজা খুলে দেব।”
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি
ট্রাম্প ইসরায়েলের আক্রমণের প্রশংসা করেছেন এবং অস্বীকার করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা না করে।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার তারা ইসরায়েলের দিকে ধেয়ে আসা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, ইরান যদি কঠিন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণে সম্মত হয়, তবে এই যুদ্ধ থামতে পারে। ইরান দাবি করছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যের জন্য, তবে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা বলছে, এটি অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহার হতে পারে।
গত রবিবার নির্ধারিত ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা বাতিল হয়েছে, কারণ তেহরান বলেছে, ইসরায়েলের হামলার মধ্যে তারা আলোচনায় বসবে না।
আপনার মতামত জানানঃ