ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষের সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী পর্বটি মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানিময় ভূখণ্ডে এক নতুন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া এই পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় শুধু কূটনৈতিক ভারসাম্য নয়, মানবিক বিপর্যয়ের ছবিও ক্রমেই গভীর হচ্ছে। ইসরায়েল কর্তৃক “Operation Rising Lion” নামে এক আকস্মিক আক্রমণে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র নতানজ, ইসফাহান, তাবরিজসহ সামরিক কমান্ড ঘাঁটিগুলো ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়। এই অভিযানে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (IRGC) শীর্ষ পর্যায়ের কমান্ডাররা প্রাণ হারান। বিশেষ করে হোসেইন সালামী ও মোহাম্মদ বাগেরির মৃত্যুর খবরে ইরানজুড়ে প্রতিশোধের ঝড় ওঠে।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান “Operation True Promise 3” নামে শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের বুকে নিক্ষেপ করে, যার ফলশ্রুতিতে তেল আবিব, রামাত গান, রিশন লেওজিয়নের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় জনজীবন তছনছ হয়ে যায়। বহু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গতি পথে বাধা পেলেও কিছু আঘাত হানে লক্ষ্যবস্তুতে। ইসরায়েলের বিভিন্ন আবাসিক ভবনে আগুন ধরে যায়, বহু পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যায়, বহু শিশু ও প্রবীণ মানুষ ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে। তিন মাস বয়সী এক শিশু ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার হয়। নিহত হয় অন্তত তিনজন, আহতের সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক ডজন। অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মাঝে রক্তাক্ত গৃহবধূ, ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে পড়া প্রবীণ পুরুষ ও শিশু রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগুনে ভবনের জানালার কাচ ছিটকে পড়ে শরীরে আঘাত হানে। কেউ কেউ নিরাপদ কক্ষে থাকলেও স্মোক ডিটেক্টর চালু হতেই দ্রুত অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। একজন বাসিন্দা জানান, বিস্ফোরণের শব্দে তার সন্তান ঘুম থেকে উঠে আতঙ্কে কেঁদে ফেলে। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে ধ্বংসস্তুপে ঢুকে আটকে পড়া শিশু ও প্রবীণদের উদ্ধার করেন। একজন ক্যাপ্টেন শিশুকে নিজের বাহুতে তুলে উদ্ধার করেন বলে জানান। এই বীরত্বপূর্ণ মানবিক চিত্রের বিপরীতে দেখা যাচ্ছে অন্য এক নির্মম বাস্তবতা—যেখানে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সাধারণ নাগরিক জীবন ও ঘরবাড়ি আন্তর্জাতিক সংঘাতের বলি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই সংঘর্ষ শুধু সামরিক বা কূটনৈতিক সংঘাত নয়, এটি এক মানবিক বিপর্যয়। যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর আক্রমণ আর পরমাণু অস্ত্র ব্যবস্থার নিচে মানুষের নিরাপত্তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুঁশিয়ার করে বলেন, তেহরান যদি আবার হামলা করে তাহলে “তেহরান পুড়ে যাবে”—এই বক্তব্য কেবল উত্তেজনাকে বাড়িয়েছে। একদিকে ইরান তার সামরিক সম্মান রক্ষায় প্রতিশোধমূলক হামলায় যাচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য জাহির করতে চাইছে।
আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন—এই সংঘর্ষ যদি থামানো না যায় তবে তা সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরব ও ইরাকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ওমান-ভিত্তিক পরমাণু আলোচনার পর্দা নামতে শুরু করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এই সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে এক অনিবার্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে, যার পরিণতিতে লক্ষাধিক সাধারণ নাগরিক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এবার যা ঘটেছে তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের কণ্ঠে আতঙ্ক—কেউই ভাবেননি এই পর্যায়ের ক্ষেপণাস্ত্র রাজধানীর হৃদয়ে এসে আঘাত হানবে। এক গৃহবধূ বললেন, “যখন জানালার কাচ ছিটকে আমার কপালে লাগে, তখন বুঝেছি আর বাঁচবো না।” অনেকেই বলছেন, সাইরেনের শব্দ শোনার পর নিরাপদ কক্ষে যাবার সময় পর্যন্ত হাতে সময় থাকে মাত্র ৩০ সেকেন্ড। তেল আবিবের উচ্চ ভবনগুলোতে আশ্রয়কক্ষ থাকলেও সেগুলো ব্যবহারে সবাই দক্ষ নয়, আর বয়স্করা এই সময়ে নিরাপদ স্থানে যেতেই পারেন না।
ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র শুক্রবার গভীর রাতে তেল আবিবের কেন্দ্রস্থলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইসরায়েলের সামরিক সদর দপ্তর আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং এতে ইসরায়েলের পেন্টাগনের সমতুল্য এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে “গুরুতর ক্ষতি” হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এবং The New York Times কর্তৃক যাচাই করা উদ্বেগজনক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এমন একটি এলাকায় হামলা হয়েছে যেখানে একাধিক সামরিক স্থাপনা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (IDF) প্রধান কমান্ড সেন্টারও।
এই ভিডিওগুলো ইঙ্গিত দেয়, ইরানের নিক্ষিপ্ত অন্তত একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে তেল আবিবের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সংবেদনশীল সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
ফক্স নিউজের প্রধান বিদেশ সংবাদদাতা ট্রে ইংস্ট现场 থেকে জানান, “এটি ইসরায়েলের পেন্টাগন বলা চলে—‘কিরিয়াত’। এই ঘাঁটির একটি ভবনে সরাসরি আঘাত হেনেছে।”
নাটকীয় ভিডিওতে দেখা যায়, আকাশে ইন্টারসেপ্টর মিসাইল ছোড়া হচ্ছে, এরপর একটি অন্ধকার আকাশ হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠে একটি বিশাল বিস্ফোরণের ঝলকানিতে, আর শোনা যায় এক প্রবল বিস্ফোরণ, যা ইঙ্গিত দেয় আসন্ন যুদ্ধাস্ত্রটি তার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।
সংঘর্ষ যতই গভীর হচ্ছে, ততই আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে দুই রাষ্ট্রের উপর। তবে কেউই আপাতত মাথা নিচু করতে রাজি নয়। যুদ্ধ বন্ধে যদি কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তবে এটাই হয়ত হয়ে উঠবে ২০২৫ সালের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা। পৃথিবীর অন্যতম স্পর্শকাতর অঞ্চল এই মধ্যপ্রাচ্য আবারও পেছনে ছিটকে পড়বে সহিংসতার গহ্বরে, যেখানে মৃত্যু আর ধ্বংস হবে প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী।
আপনার মতামত জানানঃ