মানুষ কোথা থেকে এসেছে—এই প্রশ্নটা যতটা পুরাতন, ততটাই গভীর। যুগে যুগে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ধর্ম, দর্শন, কল্পনা ও বিজ্ঞান—সবকিছুর। ধর্ম বলেছে, মানুষ সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের হাতে, বিশেষ করে ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মে বলা হয়েছে, প্রথম মানুষ ছিলেন “আদম”, যাকে সরাসরি সৃষ্টি করেছিলেন স্রষ্টা। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিষয়টি একটু অন্যরকম ভাবে দেখা যায়।
বস্তুত, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা সম্ভব যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে ধর্মের কাহিনি অনেক সময় প্রতীকী, আর বিজ্ঞান বাস্তবের বিশ্লেষণ।
এই লেখায় আমারা মানুষ কীভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে, কীভাবে “আদম” নামটি সম্ভবত একটি প্রতীকী চরিত্র, এবং আদমকে বিবর্তনের ধারার মধ্যেই একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেখা যায়, তা নিয়েই আলোচনা করব। সুতরাং, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন—এটা ঠিক, কিন্তু সেটা সরাসরি মাটির মূর্তি বানিয়ে নয়, বরং কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে।
বিবর্তন কোনো তত্ত্বমাত্র নয়, এটি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। সেই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয় প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, এককোষী প্রাণী হিসেবে। তারপর বহু যুগ ধরে সেই প্রাণীরা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় আরও জটিল রূপে—শুধুমাত্র সময়ই ছিল তাদের শিল্পী।
মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ “হোমো স্যাপিয়েন্স” এসেছে আজ থেকে মাত্র ৩ লাখ বছর আগে। কিন্তু তার আগে ছিল হোমো ইরেকটাস, অস্ট্রালোপিথেকাস, এবং অন্যান্য হিউম্যানয়েড জাতিগোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে মানুষের জিনগত মিল প্রায় ৯৮%-এর বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার এক অঞ্চলে হোমো স্যাপিয়েন্স ধীরে ধীরে আধুনিক রূপ নেয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই মানুষের ভৌগলিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তৈরি হয়।
আদমের গল্পটি আসে ধর্মগ্রন্থ থেকে। ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মে আদম হলেন প্রথম মানুষ, যাকে সরাসরি সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। কিন্তু ধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়নি কখন এবং কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি বিজ্ঞানসম্মত কোনো বর্ণনা নয়, বরং একটি প্রতীকী উপস্থাপন।
অনেক আধুনিক গবেষক এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন, “আদম” আসলে প্রতীক—একটি সময়ের, একটি পর্যায়ের, যখন মানুষ প্রথমবারের মতো নৈতিক চেতনায় উদবুদ্ধ হয়েছিল। অর্থাৎ, আদম সেই মানুষ, যে প্রথম জানতো “ভাল-মন্দ”, “সত্য-মিথ্যা” এবং সামাজিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োজন।
যখন মানুষ সমাজ গঠন শুরু করে, পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও নৈতিকতা আবিষ্কার করে—তখনই আদমের গল্পের উৎপত্তি হয়। আদম ছিলেন সেই প্রতীক, যার মাধ্যমে সমাজ বুঝতে চেয়েছে তার শেকড় কোথায়।
অনেকেই বলেন, কুরআনে বলা আছে আল্লাহ মাটি দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই মাটি কি সরাসরি কোনো মূর্তি? নাকি মাটি দিয়ে তৈরি জীবনের প্রতীক?
কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে – “আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে।” এখন যদি আমরা বিজ্ঞানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব—আমাদের শরীরের উপাদানগুলো যেমন কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন—এসব সবই পৃথিবীর মাটি থেকেই এসেছে। বিজ্ঞানও বলে, জীবন এসেছে “primordial soup” থেকে—অর্থাৎ পৃথিবীর আদিম জলাভূমির রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে।
সুতরাং, ধর্মীয় ভাষায় মাটি মানে হতে পারে পৃথিবীর উপাদান, যার মাধ্যমে আল্লাহ জীবন সৃষ্টি করেছেন। সেটি সরাসরি নয়, ধাপে ধাপে, বিবর্তনের ধারায়।
ধর্মীয় কাহিনিগুলো মূলত নৈতিকতার বার্তা দেয়। আদম-হাওয়া, বেহেশত, নিষিদ্ধ ফল—এসব হলো প্রতীকী উপাদান, যেগুলোর মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়।
যখন বিবর্তনের ধারা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে মানুষ চিন্তা করতে পারে, ভালোমন্দ বুঝতে পারে, তখনই মানুষের মধ্যে “নৈতিক বিবেক” জন্ম নেয়। এই পর্যায়কে বোঝাতেই আদম কাহিনির প্রয়োজন হয়।
অর্থাৎ আদম কোনো নির্দিষ্ট মানুষ না হয়ে হতে পারেন সেই প্রথম বিবর্তিত মানুষ, যিনি জানতেন—তিনি আছেন, এবং তিনি কিছু “সঠিক” ও কিছু “ভুল” কাজ করতে পারেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্ম মানুষ সৃষ্টি করেনি—মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে। এটা বলার মানে এই নয় যে ধর্ম মিথ্যা, বরং ধর্ম মানুষের চেতনার একটি স্তর। যখন মানুষ সমাজ গঠন করল, তখন প্রয়োজন হলো নিয়মের। আর নিয়মকে শক্তি দিতে গিয়ে মানুষ ঈশ্বরের ধারণা তৈরি করল।
এই ধর্মীয় গল্পগুলো আসলে প্রতীকী, শিক্ষামূলক, এবং সামাজিক কাঠামো তৈরির অংশ। আদম সেই কাহিনিরই একটি চরিত্র, যিনি আমাদের বিবেকের আদিম প্রতীক।
আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান, তবে তিনি তো চাইলে যে কোনো পদ্ধতিতে সৃষ্টি করতে পারেন। কেন তিনি সময় নেবেন? কেন ধাপে ধাপে সৃষ্টি করবেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে তাঁর “সুন্নাত” বা নিয়মের মধ্যে।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, “আমি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে।” বিজ্ঞান সেই পরিকল্পনাটাকেই আবিষ্কার করছে। বিবর্তন সেই মহান পরিকল্পনারই অংশ।
আমরা বিশ্বাস করতে পারি, আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন—তবে সেটা সরাসরি না হয়ে, ধাপে ধাপে, সময় নিয়ে, প্রতিটি স্তরকে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে। আদম ছিলেন সেই এক পর্যায়ের প্রতিনিধি—যেখানে মানুষ আত্মসচেতন, নৈতিক এবং বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে।
মানুষ এসেছে বিবর্তনের ধারায়, এটি বিজ্ঞানের অকাট্য সত্য। আদম ছিলেন এক প্রতীকী চরিত্র, যিনি প্রথম মানুষের নৈতিক জগতের প্রতিনিধিত্ব করেন। ধর্ম এসেছে মানুষের এই আত্মসচেতনতার পর, সমাজ গঠনের জন্য, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য।
একজন আস্তিক হলেও, আমরা সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না। আল্লাহর সৃষ্টি যদি হয়, তবে তিনিই বিবর্তনের পরিকল্পনাও করেছেন। আদম সেই সৃষ্টি পরিকল্পনার একটি স্তর। অতএব, আদম সরাসরি সৃষ্ট নন, তিনি বিবর্তিতই হয়েছেন—এবং তাঁর মধ্যেই শুরু হয়েছে মানুষের নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক জীবন।
আপনার মতামত জানানঃ