ইসলামী সংস্কৃতিতে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার, যা ঈদ-উল-আযহার অন্যতম মূল দিক। এই প্রথার মূল শিক্ষা হলো ত্যাগ, আত্মোৎসর্গ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজস্ব প্রিয় জিনিস বিলিয়ে দেওয়া। তবে আধুনিক সমাজে এই আচার পালনের পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে—বিশেষ করে পশুর প্রতি নির্মমতা এবং এর নৈতিক দিক নিয়ে।
প্রথমে বুঝতে হবে, কুরবানী মূলত একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন। এটি কেবল পশু জবাই নয়, বরং এর মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ইসলামে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, যেখানে পশুকে কষ্ট না দিয়ে, সম্মানের সঙ্গে, পেশাদার কসাই দ্বারা জবাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহর নিকট তাদের গোশত কিংবা রক্ত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৭)
কিন্তু বাস্তবচিত্র অনেক সময় এই শিক্ষার প্রতিফলন ঘটায় না। শহরাঞ্চলে কুরবানীর সময় অনেকেই অপ্রশিক্ষিতভাবে পশু জবাই করে, যেটি পশুর জন্য কষ্টদায়ক হয়। কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পশুর প্রতি দয়া ও সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও কুরবানীর সময় অনেকে পশুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে-রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে, না খাইয়ে রাখে, যা নির্মমতার পরিচয় বহন করে।
পশুর প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষাও ইসলামেই রয়েছে। হাদীসে এসেছে, “তোমরা কুরবানীর সময় পশুর প্রতি সদয় হও। জবাই করার সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার কর এবং পশুকে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দিও না।” (মুসলিম শরীফ)। তাই প্রকৃত কুরবানী মানে শুধুমাত্র পশু জবাই নয়, বরং এটি যেন একটি পরিপূর্ণ, মানবিক, নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হয়।
কুরবানী ইসলামের এক মহান বিধান—এর শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি। কিন্তু আমরা যদি কুরবানীর নামে পশুর প্রতি নির্মমতা করি, তাহলে এর আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধর্মের মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হয়। তাই আমাদের কর্তব্য হলো কুরবানীকে এমনভাবে পালন করা, যাতে পশুর প্রতি সদয় আচরণ নিশ্চিত হয় এবং এই মহান ইবাদত প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়ে পরিণত হয়।
কুরবানী হোক আমাদের সহানুভূতির প্রতীক, দয়া ও নিয়মানুবর্তিতার নিদর্শন, আর নিষ্ঠুরতার নয়। শুধু তাহলেই আমরা এই ধর্মীয় বিধানকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারবো।
ইসলামে কুরবানীর বিধান এসেছে কুরআনের বহু জায়গায়। ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাঁর আনুগত্যের পুরস্কারস্বরূপ একটি পশু পাঠিয়ে তা কুরবানী করতে বলেন। এই আত্মত্যাগের উদাহরণ আমাদের শেখায় কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে হয়।
কুরআনে বলা হয়েছে: “তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
(সূরা হজ্জ: ৩৭)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কুরবানীর বাহ্যিক রূপ নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যই আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, যদি কুরবানী কেবল একটি সামাজিক প্রদর্শন বা নিষ্ঠুর প্রথায় পরিণত হয়, তাহলে তার মূল তাৎপর্য হারিয়ে যায়।
নিষ্ঠুর প্র্যাকটিস: ধর্মবিরোধী ও মানবতাবিরোধী
আধুনিক শহুরে পরিবেশে কুরবানী অনেক সময় এমনভাবে পালিত হয়, যা পশুর প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে নির্মমতা প্রকাশ করে। কিছু সাধারণ নিষ্ঠুর চর্চা হলো:
পশুকে জবাইয়ের আগেই বহুক্ষণ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা, না খাওয়ানো বা পানি না দেওয়া। উন্মুক্ত রাস্তায়, জনসমক্ষে, অনভিজ্ঞ হাতে জবাই করা, যেখানে পশু দীর্ঘক্ষণ কষ্ট পায়। বাচ্চাদের সামনে এই দৃশ্য দেখানো, যা তাদের মানসিকভাবে প্রভাবিত করে ও সহানুভূতির পরিবর্তে ভয় বা হিংস্রতা সৃষ্টি করে। পশুকে বাহ্যিকভাবে সাজিয়ে পণ্য বানিয়ে ফেলা, যাতে কুরবানী হয়ে ওঠে ‘দেখানোর ব্যাপার’।
এই ধরনের আচরণ কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে—
“তোমরা যখন কুরবানী করো, তখন তা সুন্দরভাবে করো। ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।”
(সহীহ মুসলিম)
অতএব, যেসব চর্চা পশুকে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেয়, তা ইসলামে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
একটি মানবিক অবস্থান: কুরবানী হোক দয়া ও সহানুভূতির প্রকাশ
আমরা যদি কুরবানীর আসল শিক্ষা অনুধাবন করি, তাহলে বুঝতে পারবো যে ইসলাম কখনো নির্মমতা সমর্থন করে না। বরং, ইসলাম প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে শিক্ষা দেয়। পশু জবাই করার আগে তাকে পানি দেওয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করা, এমনকি অন্য পশুর সামনে জবাই না করা—এসবই ইসলামী আদর্শ।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত, কুরবানীর ধর্মীয় প্রথাকে রক্ষা করা, কিন্তু একইসাথে নিষ্ঠুর চর্চার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট ও পরিষ্কার স্থান নির্ধারণ করা। পশু জবাই প্রশিক্ষিত কসাই দ্বারা করানোর ব্যবস্থা করা। শিশুদের মানসিক বিকাশের কথা বিবেচনা করে কুরবানীর পরিবেশকে সংবেদনশীল রাখা। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো, যাতে মানুষ বুঝে কুরবানীর মানবিক দিক।
কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, আধুনিক যুগে কুরবানীর পশু জবাই না করে, সমপরিমাণ অর্থ দান করলে কি ত্যাগের শিক্ষা পূর্ণ হয় না? যদিও ইসলামী শরীয়ত নির্দিষ্ট নিয়মের কুরবানীকে ফরজ বা ওয়াজিব হিসেবে গণ্য করে, তবে মানবিকতার সঙ্গে কুরবানীর এই বিধানকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।
বর্তমানে অনেক উন্নত দেশ “সেন্ট্রাল স্লটারের হাউজ” এর মাধ্যমে কুরবানী করে থাকে, যেখানে পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচ্ছন্ন, প্রশিক্ষিত হাতে এবং সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশেও এই ধরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সময়ের দাবি।
কুরবানী ইসলামের এক মহান বিধান—এর শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি। কিন্তু আমরা যদি কুরবানীর নামে পশুর প্রতি নির্মমতা করি, তাহলে এর আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধর্মের মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হয়। তাই আমাদের কর্তব্য হলো কুরবানীকে এমনভাবে পালন করা, যাতে পশুর প্রতি সদয় আচরণ নিশ্চিত হয় এবং এই মহান ইবাদত প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়ে পরিণত হয়।
কুরবানী হোক আমাদের সহানুভূতির প্রতীক, দয়া ও নিয়মানুবর্তিতার নিদর্শন, আর নিষ্ঠুরতার নয়। শুধু তাহলেই আমরা এই ধর্মীয় বিধানকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারবো।
আপনার মতামত জানানঃ