প্রায় বারো মিলিয়ন বছর আগের কথা। পৃথিবীর আদি বনে-জঙ্গলে তখন ঘোরাফেরা করত বিড়াল জাতীয় একপ্রকার মাংসাশী প্রাণী। এদের বলা হয় “প্রোটো-প্যানথেরা”—যারা ছিল আধুনিক সিংহ, বাঘ, চিতা, জাগুয়ারদের পূর্বপুরুষ। তারা ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট, কিন্তু নিঃসন্দেহে শিকারি। এই প্রাণীগুলোই ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পথে বিকাশ লাভ করে তৈরি করে দেয় আজকের পৃথিবীর বড় বিড়ালদের বংশপরম্পরা।
বাঘ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris, এই শিকারি পরিবারে সবচেয়ে পুরোনো সদস্যদের একজন। গবেষণায় জানা যায়, Panthera গণের মধ্যে বাঘই প্রথম আধুনিক ধরনের বিকাশ লাভ করে। এ ধারণার ভিত্তি হল জিনগত বিশ্লেষণ, দাঁত ও হাড়ের ফসিল এবং ভৌগোলিক বিস্তারের ধারা।
বাঘের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষের ফসিল পাওয়া গেছে চীনের দক্ষিণাঞ্চলে, যেখান থেকে অনুমান করা হয় আজকের বাঘের বিকাশ শুরু হয় প্রায় দুই মিলিয়ন বছর আগে। সেই সময় পৃথিবী ছিল অনেক বেশি ঠান্ডা ও বরফে ঢাকা। প্রাণীরা নতুন পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করছিল। আর এই অভিযোজনের ধারায় বাঘের পূর্বপুরুষরা গড়তে থাকে শক্তপোক্ত শরীর, বড় পেশি, প্রখর দৃষ্টি আর নিঃশব্দে চলাফেরার দক্ষতা।
প্রাচীন সেই বাঘেরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। কোনো কোনো দল পূর্ব দিকে গিয়ে সুমাত্রা দ্বীপে আশ্রয় নেয়, কেউ বা চলে যায় রাশিয়ার বরফাচ্ছন্ন বনাঞ্চলে, কেউ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলে। এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে এক একটি অঞ্চলের বাঘ নিজেদের পরিবেশ অনুযায়ী রূপ নিতে থাকে—এর ফলেই গড়ে ওঠে বিভিন্ন উপপ্রজাতি।
এই বিবর্তনের ধারায় যে বৈশিষ্ট্যটি বাঘকে সবচেয়ে আলাদা করেছে, তা হল তার গায়ের ডোরাকাটা দাগ। এটি কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের অংশ নয়, বরং একটি অভিযোজনমূলক বৈশিষ্ট্য। গা-ঢাকা দিতে, শিকারের আগে লুকিয়ে থাকার জন্য এই দাগগুলো ছিল এক ধরণের কৌশল। ঘন পাতায়, বনের আলোছায়ার মাঝে ডোরাকাটা গায়ের বাঘকে চেনা প্রায় অসম্ভব—ঠিক এই কারণেই সে হয়ে উঠেছে নিখুঁত শিকারি।
বাঘের বিবর্তন কেবল তার শরীর বা গায়ের গঠনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, অঞ্চল চিহ্নিতকরণ, এবং পরিবার গঠন প্রক্রিয়াও পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার সাইবেরিয়ান টাইগার বিশাল এলাকা একা দখল করে থাকে, যেখানে দক্ষিণ ভারতের একটি বাঘ অপেক্ষাকৃত ছোট এলাকায় থাকে এবং বেশি সংখ্যায় বাঘের উপস্থিতি মানিয়ে নেয়।
তবে এই মহাকাব্যের একটি বিষণ্ন অধ্যায়ও আছে। বাঘের কিছু উপপ্রজাতি আজ আর বেঁচে নেই। যেমন—জাভান টাইগার, বালি টাইগার, কাস্পিয়ান টাইগার। এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে মূলত মানুষের কারণে—অবাধ শিকার, বন ধ্বংস, ও আধুনিকতার আগ্রাসনে।
বর্তমানে পৃথিবীতে মাত্র ছয়টি উপপ্রজাতি টিকে আছে। এবং তাদের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। অথচ এই বাঘ, যে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থেকেছে, মানুষের হাতেই তার অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।
বাঘের বিবর্তনের ইতিহাস কেবল একটি প্রজাতির অভিযোজন ও বিকাশের গল্প নয়। এটি প্রকৃতির গভীর পরিবর্তন, টিকে থাকার সংগ্রাম এবং শিকারি প্রাণীদের প্রতিযোগিতার এক চমৎকার দলিল। এটা আমাদের শেখায়—কোনো প্রজাতির অস্তিত্ব চিরকালীন নয়, যদি আমরা তাকে রক্ষা না করি।
এই বিবর্তনের ধারায় বাঘ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। কিন্তু সে কি আমাদের যুগেও টিকে থাকবে? সেই উত্তর নির্ভর করছে আমাদের সিদ্ধান্ত আর দায়বদ্ধতার উপর।
আপনার মতামত জানানঃ