ঢাকা মিরপুরের বাসিন্দা আব্দুল মালেককে প্রতি মাসে বাবা-মার জন্য উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ কিনতে হয়। এর পাশাপাশি তিনি আরও প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ, ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম কিনে থাকেন।
তিন মাস আগে তার এসব ওষুধ কিনতে মাসে প্রায় ৬ হাজার টাকা লাগতো। সমপরিমাণ ওষুধ কিনতে তাকে এখন আট হাজারের বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। শুধু মালেক নন, তার মতো অসংখ্য মানুষকে ওষুধের দাম বাড়ায় খরচ করতে হচ্ছে বাড়তি টাকা যদিও আয় বাড়েনি একটাকাও।
সরকারি একটি গবেষণাতে দেখা গেছে, চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এই ব্যয়ের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধে। জানা যায়, ৩০৮টি ওষুধ কোম্পানি দেশে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে।
দেশে দেড় হাজারেরও বেশি জরুরি ওষুধের ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হয়। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকার ওষুধ রয়েছে ২১৯টি। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলো নিজেরাই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওষুধের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ওষুধের কাঁচামাল, লেবেল, মোড়ক সামগ্রী, মার্কেটিং খরচ ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে এবং কোম্পানিগুলো ওষুধ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কিংবা ভুল বুঝিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত ওষুধের মূল্য বাড়িয়ে নিচ্ছে।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে ফার্মেসি থেকে পাওয়া তথ্য মতে, একমি কোম্পানির মোনাস ১০ এক (৩০ পিস) বক্সের দাম আগে ছিল ৪৮০ টাকা, এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৫২৫ টাকা। স্কয়ারের এনাফ্লেক্স ম্যাক্স ৫০০ মি.গ্রা. ১৩০ টাকার স্থলে বর্তমান দাম ২১০ টাকা। স্কয়ারের এনাডল এস আর ১০০ মি.গ্রা. ১২০ টাকা থেকে দাম বেড়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরিস্টোফার্মা এক্সিম সিভি ৫০০ মি.গ্রা ৫০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা। এসিআই কোম্পানির টেট্রাসল ৮০ টাকা থেকে ১২৫টাকা, ইনসেপ্টার এলিমেট প্লাস লোসন ১১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, স্কয়ারের রসুভা ১০ মি. গ্রা. ২০০ টাকা থেকে দাম বেড়ে ২২০ টাকা। বেক্সিমকোর রসুটিন ১০ মি.গ্রা. প্রতি বক্সে দাম বেড়েছে ৬০ টাকা, স্কয়ারের এসিন্টা ম্যাক্স ২০০ এমএল বোতল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা, এরিস্টোফার্মার এভোল্যাক সিরাপ ১০০ এমএল বোতলের দাম ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা এবং ২০০ এমএল বোতল ২৪০ থেকে ৩২০ টাকা হয়েছে।
এছাড়াও একমি কোম্পানির এন্টিবায়োটিক এজিন ৫০০ মিগ্রা প্রতি ট্যাবলেটে দাম বেড়েছে ২০ টাকা। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির ওএমজি-৩০০ ক্যাপসুলের প্রতিটির মূল্য ৪০ টাকা বেড়েছে। একমি কোম্পানির গ্যাসের ওষুধ ডিডিআর ৩০ মি.গ্রা. প্রতি পাতায় বেড়েছে ১৫ টাকা। বেক্সিমকোর উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এমডাকল ৫ মি. গ্রা. এর দাম ৭৩ টাকা থেকে বেড়ে ৮২ টাকা হয়েছে। নাপা সিরাপ ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, স্কয়ারের ইভিট ৪০০ মি. গ্রা. ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে।
ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ করেই প্রায় অর্ধশত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি। অন্যান্য ওষুধের দাম ৩০ থেকে প্রায় ৯০/১০০ শতাংশ বেড়েছে।
বর্তমান সময়ে ওষুধের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটুকু জানতে চাইলে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির মত কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ওষুধের দাম বাড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের দামের যে পরিবর্তন ঘটেছিল, সেটিও প্রায় দুই বছর আগের ঘটনা। বর্তমান সময়ে দাম বাড়ার সঙ্গে তারও কোনো সম্পর্ক নেই। ওষুধের দাম বাড়াতে হলে, একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে, সেখানে মিটিং করে দাম বাড়াতে হয়। সেরকম কোন মিটিং হয়েছে বলেও আমরা শুনি নাই। এর অর্থ হচ্ছে কোন একটি চক্র খেয়ালখুশি মতো ওষুধের দাম বৃদ্ধি করছে। সরকার এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জনসাধারণের উপর দুই ভাবে পড়বে। প্রতি বছর ৬০ লাখের বেশি মানুষ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। ওষুধের দাম বাড়ার ফলে এই সংখ্যাটা আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে ওষুধের দাম বাড়ার ফলে নিম্নবিত্ত একটি অংশ ওষুধ কিনতে পারবে না, এতে তাদের অসুস্থতা দীর্ঘায়িত হবে। আবার অনেকেই ওষুধ কিনতে গিয়ে খাবারের গুণগত মান কমিয়ে দেবে, এতে পুষ্টিহীনতা বাড়বে। পুষ্টিহীনতা তৈরি হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রতিযোগিতা বেশি থাকলে দাম কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু যেসব ওষুধ বেশি বিক্রি হয় বা চাহিদা বেশি, সেগুলোরও দামও বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও তা নিশ্চয়ই ৫০ কিংবা ৭০ শতাংশ বাড়েনি। কিন্তু কিছু ওষুধের দাম তার চেয়েও বেশি বাড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, জীবন রক্ষাকারী যে ওষুধগুলোর দাম ওষুধ প্রশাসন নির্ধারণ করে দেয়, সেগুলোর দাম মোটামুটি যৌক্তিক। এর বাইরে কিছু ওষুধের দাম বেশি মনে হয়। কারণ এসব ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, কোম্পানিই এসব ওষুধের দাম নির্ধারণ করে। অনেক কোম্পানি আছে, তাদের ওষুধের দাম এমনিতেই অনেক বেশি রাখে।
ওষুধ কোম্পানির গড়ে প্রফিট মার্জিন কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো গড়ে ৫০ শতাংশের কম বেশি, এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ লাভ থাকে। ওষুধ কোম্পানির প্রফিট মার্জিন বাজারে অন্যান্য পণ্যের থেকে অনেক অনেক বেশি।
কোম্পানির পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার দেয়ায় ওষুধের দামের উপর কি প্রভাব ফেলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার দেয়া, অনৈতিক সকল ব্যয় ওষুধের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সেই মূল্য ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হয়। কোম্পানির অযৌক্তিক এসব ব্যয় কমালে অনেক ওষুধের মূল্য বেশ কমে আসবে।
ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে খবর হচ্ছে, নতুন ডিজি (ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) আসার পর কিংবা আগে যে ডিজি ছিল, সেই সময়ে একটা ওষুধের দামও বাড়েনি। বাজারে যদি দাম বেড়ে থাকে তাহলে অন্যভাবে বেড়েছে।
প্রতিবেদক সরেজমিনে বিভিন্ন ফার্মেসিতে খোজ নিয়ে দাম বাড়ার তথ্য জানালে তিনি বলেন, দুই, তিন মাস কিংবা ছয় মাসেও কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। আপনি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের খোঁজ নিয়ে দেখেন কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক এবং মুখপাত্র ড. মো. আকতার হোসেন দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, আমি অল্প কয়েকদিন থেকে দায়িত্ব পেয়েছি, তাতে দেখলাম গত পাঁচ ছয় মাসে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয় নেই। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের পরিচালক আশরাফ হোসেন ভালো বলতে পারবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্রের কথার সূত্র ধরে পরিচালক আসরাফ হোসেনের কাছে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন স্যার (মহাপরিচালক) তিন মাস থেকে আসছে, এই সময়ে নতুন স্যার কোনো দাম বাড়ায়নি এবং সমন্বয়ও করেনি। তার আগেও বাড়ানো হয়নি, তবে কোনো কোনো কোম্পানির দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, যেমন কোনো কোম্পানির কোনো ওষুধের দাম আট টাকা, আবার একই ওষুধ অন্য কোম্পানির ১২ টাকা দাম, এভাবে কিছু দাম সমন্বয় করা হয়েছে। গত ছয় মাস কিংবা এক বছর যাই বলেন না কেন, ম্যাক্সিমাম প্রাইস থেকে বেশি কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কার্যকর ভূমিকার অভাব এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া মুনাফার কারণে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছেন। ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া মুনাফার বলি হয়ে আরও অসংখ্য মানুষ সর্বস্বান্ত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ