টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট ও জ্বালানির প্রাপ্যতা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতে আগ্রহ বাড়ছে সরকারের। এর ধারাবাহিকতায় গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
গতকালও অনুমোদন পেয়েছে নতুন তিনটি সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়বে ১০ টাকার বেশি। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে সৌরবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় এর প্রায় অর্ধেক। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে এগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। সৌরবিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে জীবাশ্ম জ্বালানির মডেলটিকেও অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুষ্ঠিত সভায় গতকাল নতুন করে তিনটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ২০ বছর মেয়াদে কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনায় সরকারের ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকায় ২০০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০ বছর মেয়াদে আনুমানিক ৭ হাজার ১৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় ৭০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০ বছর মেয়াদে আনুমানিক ২ হাজার ৪৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায় ১০০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০ বছর মেয়াদে আনুমানিক ৩ হাজার ৫৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। তবে এ তিন কেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে কত টাকা ব্যয় হবে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
এর আগে গত মাসে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় দুটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ অনুমোদন করা হয়েছিল। এর মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে ৩০০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সৌদি আরবের এসিডব্লিউএ পাওয়ার কোম্পানি, বাংলাদেশের কমফিট কম্পোজিট নিট লিমিটেড, ভিয়েলাটেক্স স্পিনিং লিমিটেড ও মিডল্যান্ড ইস্ট পাওয়ার লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চারকে অনুমোদন দেয়া হয়। নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টের ভিত্তিতে ২০ বছর মেয়াদে ১২ শতাংশ ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর, ৬ শতাংশ উৎসে কর ও ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে ট্যারিফ ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেনা হলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ১১ টাকা ৭ পয়সা হিসাবে আনুমানিক ১০ হাজার ৭৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ওই সময় নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় ৫০ মেগাওয়াট (এসি) ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এএসকে নিউ এনার্জি কো. লিমিটেড, এ জে পাওয়ার কো. লিমিটেড ও এটিএন সলিউশনস লিমিটেডের কনসোর্টিয়ামের ট্যারিফ অনুমোদন দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ২০ বছর মেয়াদে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ১০ টাকা ৭ পয়সা হিসাবে আনুমানিক ১ হাজার ৭৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরেও সৌর শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় হয়েছে ১০ টাকার বেশি। এর মধ্যে এনগ্রিন সোলারের কাছ থেকে প্রতি কিলোওয়াট ১৬ টাকা ৪২ পয়সা, সিম্পা সোলার পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে ১১ টাকা ২৬ পয়সা, স্পেকট্রা সোলার পার্ক থেকে ১১ টাকা ৯৬ পয়সা, কেইপিজেড ৯ দশমিক ৮ মেগাওয়াট সোলার থেকে ১২ টাকা ৯৩ পয়সা ও এনারগন রিনিউয়েবলস (বিডি) লিমিটেডের কাছ থেকে ১২ টাকা ১১ পয়সায় বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌরবিদ্যুতের প্রতি কিলোওয়াট উৎপাদন গড় খরচ ছিল ১৩ টাকা থেকে ১৭ টাকার মধ্যে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৩ টাকায় নেমে এসেছে। দেশে বৃহৎ কয়েকটি সৌরবিদ্যুতের প্রকল্প গ্রিডে যুক্ত হওয়ায় উৎপাদন খরচ কমে আসছে। আগামী বছর এ খরচ ইউনিটপ্রতি ৯-১০ টাকায় নেমে আসবে।
গত এক দশকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে। ২০১০ সালে ভারতে প্রতি কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল দশমিক ১৭ সেন্ট। সেখানে ২০২০ সালে কিলোওয়াটপ্রতি নেমে এসেছে দশমিক শূন্য ৩১৫ সেন্টে। ২০২০ সালে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি সাতলুজ জাল বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড (এসজেভিএন) ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে। ৪৫০ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয় প্রতি কিলোওয়াট ২ রুপি ৮০ পয়সা।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাইয়ে ২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। দরপত্রের ভিত্তিতে করা সোলারের প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয় দশমিক শূন্য ৩২ সেন্ট। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে গতকালের ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ধরে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৩ টাকা ৫৩ পয়সা। দরপত্রে বিজয়ীরা ভারতের যেকোনো জায়গায় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবে।
ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জের (আইইএক্স) তথ্য বলছে, গতকাল গ্রিন ডে-অ্যাহেড মার্কেটে প্রতি কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুতের ভারিত গড় মূল্য ছিল ৫ দশমিক ৫৯ রুপি। অন্যদিকে গ্রিন টার্ম- অ্যাহেড মার্কেটে প্রতি কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুতের ভারিত গড় মূল্য ছিল ৫ দশমিক ৪৪ রুপি।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে, ভারতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। ফলে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম পড়ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বিশেষ আইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। যেখানে বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে একটি নির্ধারিত ট্যারিফের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফ এখনো বেশি। এর কারণ হলো এখানে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে না। ফলে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে বিদ্যুতের ট্যারিফ ঠিক করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘসময় লেগে যাওয়ায় এক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি অনুভব করে। এ ঝুঁকিও উচ্চ ট্যারিফের কারণ। তৃতীয়ত, সৌরবিদ্যুতের বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায়ও ট্যারিফের ওপর প্রভাব পড়ে। খরচ কমাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনুমোদনগত জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে, জমি অধিগ্রহণ ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।’
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৪৫৯ মেগাওয়াট, যা বিপিডিবির বিদ্যমান সক্ষমতার ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়াতে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৬) ২০২১ সালের মধ্যে মোট সক্ষমতার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ থেকে করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয় বিদ্যুৎ বিভাগ। বর্তমানে সংশোধিত বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে মোট ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সোলার পার্ক থেকে ৪৬১ মেগাওয়াট এবং রুফটপ সোলার থেকে প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া ১ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং প্রায় নয় হাজার মেগাওয়াটের সোলার প্রকল্পগুলোর কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সোলার প্রকল্পের বেশির ভাগই নদীর চর ও দুর্গম এলাকায়। গ্রিড লাইনের সঙ্গে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত করতে গিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত সোলার প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে নৈকট্য ও বিদ্যুতের উৎপাদন-সরবরাহ ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিবেচনায়। এছাড়া সোলার প্যানেল নির্মাণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের বড় অংশ ভারত নিজেই উৎপাদন করছে। সিলিকনসহ প্যানেলের যন্ত্রাংশ উৎপাদনে সেখানে সরকারি প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এ ধরনের সুযোগ এখনো অবারিত নয়। আবার বাংলাদেশের বাজারে এখনো সৌর প্যানেলের যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে মুনাফা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। আগামীতে এটি আরো কমে আসবে। প্রতি কিলোওয়াট ৮-৯ সেন্টে আসবে। তবে বিতর্কও রয়েছে, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুতের দাম অনেক বেশি। আসলে সৌরবিদ্যুতের দুটি বিষয় নির্ভর করে। এর একটি হলো জমি, অন্যটি সূর্যের তাপ (রেডিয়েশন)। আমাদের দেশে জমির স্বল্পতা ও মূল্য অনেক বেশি। এছাড়া ওই দেশগুলোর তুলনায় সূর্যের তাপও পাওয়া যায় কম। ইফিশিয়েন্সি বেশি না হলে খরচ তখন বেড়ে যায়। আমরা চেষ্টা করছি, সৌরবিদ্যুতের খরচ কীভাবে আরো কমিয়ে আনা যায়।’
আপনার মতামত জানানঃ