বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার পথে গত ৮ বছর ৯ মাসে ১৫৫ বাংলাদেশি মারা গিয়েছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এ তথ্য সংগ্রহ করেছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে জার্মানির বার্লিন থেকে মঙ্গলবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে আইওএম।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছেন সিরিয়ার নাগরিক, ৭৯১ জন। শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে সপ্তম স্থানে আফগানিস্তান ও ১৭তম স্থানে পাকিস্তান। এ সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের ২৭০ জন এবং পাকিস্তানের ৯১ জন নাগরিক মারা গিয়েছেন। এরা সবাই ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি বা স্থল সীমান্ত অতিক্রম করার সময়ে মারা গিয়েছেন।
এদিকে চলতি বছরের আইওএম প্রকাশিত বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী অভিবাসী পাঠানোয় বিশ্বে ষষ্ঠ এবং রেমিট্যান্স গ্রহণে ৮ম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
আর ইউরোপ নিয়ে ২০২০ সালের আইওএমের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সমুদ্র ও স্থল সীমান্ত দিয়ে অনিয়মিতভাবে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ইউরোপে প্রবেশ করেছে মোট ১৩ হাজার ৩৫৪ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে মূল ইউরোপে প্রবেশ করেছেন চার হাজার ৫১০ জন বাংলাদেশি। আর এর বাইরে পশ্চিম বলকানের দেশগুলোতে ৮ হাজার ৮৪৪ জন বাংলাদেশির প্রবেশ করেছেন।
আর জাসিতংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর থেকে সংস্থাটি ৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে। ইতালিতেই অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে পাঁচ হাজার ৮০ বাংলাদেশি।
প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছেন সিরিয়ার নাগরিক, ৭৯১ জন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌযানডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েছে। এই অবৈধ অভিবাসীদের দলে বাংলাদেশিদের থাকার খবর আগেও এসেছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচারকারীরা ইউরোপের উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইএমওর তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময় মারা গেছেন ২ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী। যা আগের বছর ছিল ১৪০০।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে।
ভালো পারিশ্রমিকের আশায় কয়েক বছর ধরে পাচারকারীদের সহায়তায় লিবিয়া যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেখান থেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আছেন আটক অবস্থায়।
মানব পাচারের দিক থেকে আন্তজার্তিক সংস্থার তালিকাতে কেন বাংলাদেশ শীর্ষে? আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে সর্বপ্রথম যে কারণটি আসবে তা হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সূত্র মতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৮০টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য জন্য মানব পাচার কমানো যাচ্ছে না। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাত আছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব পাচারের আরো একটি কারণ হলো অসচেতনতা। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতন করা। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো। এছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্রসীমা সুরক্ষার জন্য আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন দরকার বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩২
আপনার মতামত জানানঃ