আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স হ্রাসের কারণে গত কয়েকমাস ধরে চাপের মধ্যে রয়েছে রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
তবে সম্প্রতি দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মঙ্গলবার (১২ জুলাই) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। উল্লেখ্য, বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (এসিইউ)-কে আমদানির ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯.৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, নেপাল, পকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা- এসিইউ সদস্য এই দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে দুই মাস পর পর টাকা পরিশোধ করতে হয়।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স হ্রাসের কারণে গত কয়েকমাস ধরে চাপের মধ্যে রয়েছে রিজার্ভ।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে। মূলত খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সরকারি কেনাকাটায় খোলা এলসি সেটেলমেন্টে এই সাপোর্ট দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ১০ লাখ (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এছাড়া আমদানি কমাতে ও রপ্তানি উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯৩.৪৫ টাকা রেটে ডলার বিক্রি করছে। এক বছর আগে এই রেট ছিল ৮৪.৮০ টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে ৭৮ বিলিয়ন ডলার হয়।
অন্যদিকে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। একই অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করলে আকুর বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করত বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঈদের আগে প্রবাসীরা যেভাবে বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, আকুর দেনা শোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের ওপর থাকবে। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে সেটা আর সম্ভব হলো না। সামান্য কম আছে, দুই-এক দিনের মধ্যেই ৪০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।’
ঈদের ছুটির আগে সাত দিনেই ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে সাত দিনের এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। গড় হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক সপ্তাহে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরের চেয়েও বেশি দামে রেমিট্যান্স দেশে আনছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৯৫/৯৬ টাকায় প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশে আনছে।
এ হিসাবে টাকার অঙ্কে এই সাত দিনে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
রেমিট্যান্সপ্রবাহে নিম্নমুখী ধারায় শেষ হয় ২০২১-২২ অর্থবছর। ৩০ জুন শেষ হওয়া এই অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
এদিকে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ১০ জুলাই দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশুসহ প্রয়োজনীয় অন্য কেনাকাটা করতে অন্যান্যবারের মতো এবারও পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সে কারণেই রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
ঈদের ছুটির আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছয় দিনের (১ থেকে ৬ জুলাই) রেমিট্যান্সের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে (১ থেকে ৫ জুলাই) এসেছিল ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৬ জুলাই এসেছিল ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
ঈদের ছুটির পর মঙ্গলবার চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের রেমিট্যান্সের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১ থেকে ৭ জুলাই মোট ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ৭ জুলাই এসেছিল ১৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
এর আগে কোনো ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি।
আমদানি ব্যয় বাড়ায় গত ৯ মে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের রেকর্ড ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর সপ্তাহ খানেক রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় কয়েক দিন পর অবশ্য তা ৪২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করায় সেই রিজার্ভ ফের ৪২ ডলারের নিচে নেমে আসে; একপর্যায়ে তা ৪১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল।
এর আগের মেয়াদে অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আকুর ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল শোধ করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। মে মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ