যুদ্ধ থেকে এক কদম দূরে ইউরোপ। একটা ভুল বা অতি সাহসী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে যুদ্ধের দামামা। পূর্ব ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। এমনকি রাশিয়ার সেনাবাহিনী সেখানে ‘শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে’ বলে পুতিন জানিয়েছেন।
যদিও ইউক্রেন বলছে, তারা এতে মোটেও ভীত নয়, আর তারা নতি স্বীকার করবে না। এদিকে এই দুটি অঞ্চলের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার হুশিয়ারিও দিয়েছে।
ইউক্রেনের দুই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি
পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিদ্রোহীদের দুই অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
মস্কোর স্থানীয় সময় সোমবার রাতে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেন এক সময় রাশিয়ার ভূমি ছিল। তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, রাশিয়ার জনগণ তার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবে।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, পুতিন জার্মানি ও ফ্রান্সের নেতাদের ফোনকলে তার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে ডিক্রিতে সই করে তিনি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এ ভাষণ দেন।
সোমবার রুশ প্রেসিডেন্টের নেওয়া এই পদক্ষেপে বড় আকারের যুদ্ধের আশঙ্কা করছে পশ্চিমারা। এই নির্দেশের পর ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক যন্ত্রপাতি এসব এলাকায় প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
দীর্ঘ ভাষণে পুতিন ওই অঞ্চলের ইতিহাস তুলে ধরেন। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়েও কথা বলেন তিনি।
পুতিন বলেন, ‘আমি মনে করি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। যে সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তা হলো অবিলম্বে দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক-এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেওয়া।’
এর আগে পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয় তাহলে সেটা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেসব রাষ্ট্র হয়েছে, সেগুলোর ওপর রাশিয়ার প্রভাব ফিরিয়ে আনতে কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর এই লক্ষ্য পূরণে ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
এখন বিদ্রোহীদের দুই অঞ্চলের স্বাধীনতার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সেখানে রাশিয়ার সেনা পাঠানোর সুযোগ তৈরি হলো। সম্প্রতি ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্ত ঘিরে লক্ষাধিক সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া। পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে যাচ্ছেন বলে বারবার বলে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে রুশ সৈন্য
টেলিভিশনের দেয়া এক ভাষণে পুতিন ইউক্রেনের সম্পর্কে বলেন, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি যেটা ‘পুতুল সরকারের’ মাধ্যমে চলছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ধারণাকে তিনি রীতিমত আক্রমণাত্মক ভাবে বলেন “এটা সরাসরি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি”।
পুতিন যুক্তি দেন, ন্যাটো রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টা আমলে নেয়নি। ভাষণ শেষ করার সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন যে রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোকে স্বীকৃতি দেবে রাশিয়া।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে বিদ্রোহীদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করা বন্ধ করতে হবে, না হলে এর পরিণতি মোকাবেলা করতে হবে। এর কিছু পরেই বিদ্রোহী অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি দুইটা ডিক্রিতে সই করেন। সেখানে বলা হয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সেখানে “শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে”।
তবে “শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত” থাকার অর্থ আসলে কী, সেটি নির্দিষ্ট করে বলেনি রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন এখন “আনুষ্ঠানিকভাবে” ইউক্রেনের বিদ্রোহী এলাকাতে রুশ সৈন্য পাঠাতে পারবে।
ডোনেস্ক এলাকায় পাঁচটি ট্যাংক এবং শহরের অন্য এলাকায় আরও দুইটি ট্যাংক দেখার কথা জানিয়েছেন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদক। তবে এসব ট্যাংক কাদের সেরকম কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি বলে জানান তিনি।
মস্কোর এ পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সোমবার গভীর রাতে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন মোটেই ভীতসন্ত্রস্ত নয়। ইউক্রেন কাউকে কিছু দেবে না। শান্তি আলোচনাকে নস্যাৎ করার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেছেন জেলেনস্কি।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিবিসির মস্কোর সংবাদদাতা স্টিভ রোসেনবার্গ বলছেন, অনেক বছর আগে যখন রাশিয়া প্রথম পূর্ব ইউক্রেনে সৈন্য সমাবেশ ঘটায় তখন মস্কোই মূলত এই বিদ্রোহী অঞ্চল সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে ভ্লাদিমির পুতিনের এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ‘ইতিহাস বদলে দেওয়া একটি মুহূর্ত’।
প্রথমত, এটা মূলত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া শান্তি প্রক্রিয়াকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় পুতিন নিজেও অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
একই সঙ্গে পূর্ব ইউক্রেনে একটা বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। আর এই ডিক্রিতে সই করার অর্থ হল এটা পরিষ্কার যে ভ্লাদিমির পুতিন ইতিমধ্যে ঐসব বিদ্রোহী এলাকায় সৈন্য পাঠাচ্ছে।
এর মধ্যে রাশিয়ার দাবি, পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ৬০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬১ হাজার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ায় ঢুকেছে। নয়টি ট্রেনে করে কিছু মানুষকে এখন রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্ধার অভিযানকে সাজানো বলে বর্ণনা করছে। তারা বলছে, এটি ইউক্রেনে রাশিয়ার আসন্ন অভিযান থেকে দৃষ্টি অন্যখাতে প্রবাহিত করার একটা চেষ্টা।
এদিকে পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্কে রোববার যে গোলাবর্ষণে দুজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, তার জন্য রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীকে দায়ী করেছে।
তবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইউক্রেনের সরকার। তারা বলছে, এটি আরেকটি সাজানো হামলার ঘটনা, যার মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে একটি বৃহত্তর সংঘাতের উস্কানি দেয়া হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ