কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিধি-নিষেধের মধ্যে নিজেদের ধর্ম পালন করতে হয় তিব্বতের মুসলিমদের। সারা দিন কাজ করার পর তারা মসজিদে যায় এবং নামাজ আদায় করে। আর এর সবই করতে হয় চীন সরকারের কঠোর ধর্মবিরোধী মনোভাব ও তৎপরতার মধ্যে। অবশ্য রমজান উদযাপনের জন্য তিব্বতের অনেক ধনী মুসলিম প্রতিবেশী দেশে চলে যায়।
১৪ শতাব্দির দিকে নেপাল, চীন ও কাশ্মীরের ব্যবসায়িরা তিব্বতে বসবাস করতে শুরু করে। স্থানীয় তিব্বতি নারীদের সঙ্গে ব্যবসায়িরা সংসার শুরু করলে শুরু হয় তাদের স্থায়ী বসবাস। সেসময় মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিয়ে অনেক বৌদ্ধ নারী ধর্মান্তরিত হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় তিব্বতিয়ান মুসলিমদের যাত্রা।
একই সংস্কৃতি, ভাষা ও পোষাক হলে তিব্বতে বসবাসরত মুসলিমদের খাচি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। যদিও এ নিয়ে সেখানকার মুসলিমদের মধ্যে আপত্তি আছে। কিন্তু অনেকটা জোরপূর্বক তাদের এই উপাধি দেওয়া হয়েছে।
১৯৫০ সালে যখন চীন তিব্বত দখল করলো, তখন দালাই লামাসহ আরও অনেকে ওই অঞ্চল ত্যাগ করে। সেসময় অনেক মুসলিমও তিব্বত ছেড়ে আশপাশের অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। কারণ তাদের মনে ভয় ছিলো যে, চীনা কমিউনিস্ট সরকার তিব্বতের ঐতিহ্য ও ধর্মগুলো নষ্ট করে দেবে।
বর্তমানে তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা সবচেয়ে বড় মুসলিম কমিউনিটি বসবাস করছে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরে। এছাড়া হিমালয় ঘেষা দার্জিলিং, কালিমপং এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও তাদের বসবাস আছে। এছাড়া নেপালে বসবাস করছে তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা ১২০টি মুসলিম পরিবার।
এসব মুসলিমদের আদি বাসস্থান বিবেচনা করে কাশ্মীরে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিব্বতে খুব স্বল্প সংখ্যক মুসলিমের বসবাস আছে। যারা বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আছে। বিশেষ ধর্মীয় কারণে তাদের অনেকে তিব্বতী জনগণ হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের বলা হয় হুই। যার মানে তিব্বতিয়ান নয়। যার কারণে তিব্বতে বসবাসরত মুসলিমরা এখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে।
পাহাড়-পর্বত ও তুষারে ঢাকা তিব্বতের জনসংখ্যা তিন লাখ ৮০ হাজার (পরিসংখ্যান ২০১৪)। তিব্বতের বেশির ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে সেখানে কয়েক হাজার মুসলিমও রয়েছে। নিষিদ্ধ নগরী খ্যাত তিব্বতের রাজধানী লাসায় চার হাজার মুসলিম বসবাস করে। এখানে রয়েছে চারটি মসজিদ ও দুটি মাদ্রাসা। লাসার বাইরেও বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমরাই প্রধানত তিব্বতের মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব দেয়। তাই ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে পাকিস্তানি, বিশেষত কাশ্মীরি মুসলিমদের ঐতিহ্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
তিব্বতে ইসলামের আগমন হয় প্রায় তিন শ বছর আগে। খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাশ্মীর-লাখাদের মুসলিম ব্যবসায়ীরা তিব্বতে আসেন। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে তিব্বতে ইসলাম প্রচারেরও কাজ করেন। তাদের অনেকেই সেখানে স্থায়ী হন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তা করেন। তিব্বতের পঞ্চম দালাই লামা মুসলিমদের মসজিদ স্থাপন, ভূমি ক্রয় ও স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেন।
তিব্বতের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জোরালো নজরদারি রয়েছে চীন সরকারের। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আলোচনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচি কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়। সরকারের অনুমোদন ব্যতীত কোনো কিছুই সেখানে আলোচনা বা পাঠযোগ্য নয়।
১৭১৬ সালে রাজধানী লাসায় ‘বাদাআ মসজিদ’ নামে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালে লাসায় অনুরূপ আরেকটি মসজিদ স্থাপন করা হয়। কাশ্মীরি মুসলিমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শহর শিকতসিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে মুসলিম ব্যবসায়ীরা তিব্বতের কংসু, কিংসাইসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক মসজিদ নির্মাণ করেন। পূর্ব তিব্বতের গুরুত্বপূর্ণ শহর চ্যাংডুতে রয়েছে তিনটি মসজিদ। তবে কাশ্মীরি মুসলিমরা ছাড়াও চীনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীরা তিব্বতে এসে স্থায়ী হয়েছেন। আর সবার আগে সেখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান সালিত ইবনে আবদুল্লাহ হানাফি (রহ.)-এর নেতৃত্বাধীন ইসলাম প্রচারক দল।
খ্রিস্টীয় সতেরো শতকে ইসলামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে তিব্বতে মুসলিমরা স্বাধীনভাবেই ধর্মচর্চা করে আসছিল। যদিও বৌদ্ধ ধর্মের পূণ্যভূমি তিব্বতে ইসলামের খুব বেশি প্রসার ঘটেনি। তিব্বতে চীনা শাসন প্রতিষ্ঠার পর অন্য ধর্মাবলম্বীদের মতো স্বাধীনতা হারায় মুসলিমরা। ধর্মপালনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে ১৯৫০ সালে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগ করে অনেক মুসলিম। তারা প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এখনো তিব্বতের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জোরালো নজরদারি রয়েছে চীন সরকারের। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আলোচনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচি কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়। সরকারের অনুমোদন ব্যতীত কোনো কিছুই সেখানে আলোচনা বা পাঠযোগ্য নয়।
ধর্মপালন, ধর্মীয় আলোচনা, শিশুদের কোরআন শিক্ষার ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ থাকায় তিব্বতের অনেক ধনী মুসলিম রমজানে প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যায়। বিশেষত ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে দেশান্তরিত তিব্বতি মুসলিম আত্মীয়র কাছে যান তারা। সেখানে রমজান উদ্যাপন করেন। কেউ রমজানের পুরো সময় সেখানে থাকেন, আবার কেউ রমজানের শেষাংশে সেখানে আসেন। প্রতিবেশী দেশে তারা শিশুদের কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করেন। রমজান শেষে আবার দেশে ফিরে যান তারা।
চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তিব্বতে বহু মানবাধিকার লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠেছে। ২০২১ সালে বেশ কিছু তিব্বতীয়ন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের বন্দি ও আটক করেছে চীন। তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের মুখপাত্র তেনজিন লক্ষী এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেছেন, তিব্বতের বিষয় এখনো জীবন্ত এবং এটি চীনের এখনো অন্যতম ইস্যু। ২০২২ সালের শুরুতে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই’কে বলেন, ২০২১ সালে তিব্বতে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
তেনজিন বলেন, অনেক রাজনৈতিক নেতা তিব্বত সফর করেছেন এবং সারা বছরজুড়ে তারা ধারণা করেছেন তিব্বত ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ছিল কিন্তু তারা এখন বুঝতে পেরেছেন তিব্বত এখনো পুড়ছে।
এই মুখপাত্র আরো বলেছেন, তিব্বত এখনো চীনের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি এবং এটি দমন করতে চীন আরো যুদ্ধাংদেহী। তারা তিব্বতের সমস্ত ঐতিহ্যের নিন্দা করছিল এবং তারা তিব্বতের সব ঐতিহ্যকে মুছে ফেলছে।
এছাড়া তিব্বতের অনেক স্কুল ধবংস করা হয়েছে এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বলে এই মুখপাত্র।
মূলত বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী এই দুর্গম অঞ্চলটি ‘বিশ্বের ছাদ’ নামেও পরিচিত।তিব্বতকে চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসাবে রেট দেওয়া হয়। চীন বলেছে যে কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে তার সার্বভৌমত্ব রয়েছে, আবার অনেক তিব্বতীরা তাদের নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার প্রতি তাদের আনুগত্য বজায় রেখেছে।
তার অনুসারীরা যখন দালাই লামাকে জীবন্ত ঈশ্বর হিসাবে দেখেন, চীন তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে। তিব্বতের ইতিহাস অত্যন্ত উত্তাল । কখনও কখনও এটি একটি স্ব-দখলকৃত অঞ্চল হিসাবে থেকে যায়, এবং কখনও কখনও মঙ্গোলিয়া এবং চীন এর শক্তিশালী রাজবংশগুলি এটি শাসন করে।
তবে ১৯৫০ সালে চীন এই অঞ্চলে তাদের পতাকাটি প্রেরণের জন্য কয়েক হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল। তিব্বতের কিছু অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং বাকি অঞ্চলগুলি এর সাথে সংযুক্ত চীনা প্রদেশগুলিতে একীভূত করা হয়েছিল।
তবে ১৯৫৯ সালে চীনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহের পরে ১৪ তম দালাই লামাকে তিব্বত ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল যেখানে তিনি নির্বাসিত সরকার গঠন করেছিলেন। তিব্বতের বেশিরভাগ বৌদ্ধ বিহারগুলি ষাটের এবং সত্তরের দশকে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ধ্বংস হয়েছিল। দামান ও সামরিক শাসনামলে হাজার হাজার তিব্বতী নিহত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
চীন ও তিব্বতের মধ্যে বিরোধ তিব্বতের আইনী অবস্থান সম্পর্কিত। চীন বলেছে যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই তিব্বত চীনের একটি অঙ্গ ছিল, তবে তিব্বতীরা বলেছে যে তিব্বত বহু শতাব্দী ধরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল এবং চীন এর অধিকারী ছিল না।
তিব্বত নির্বাসিত সরকার বলে, ‘এ নিয়ে কোনও বিরোধ নেই যে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে তিব্বত বিভিন্ন বিদেশী শক্তির প্রভাবে ছিল। নেপালের মঙ্গোল, চীনের মাঞ্চু রাজবংশ এবং যারা ভারত শাসন করেছিল তিব্বতের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসকদের সবার কিছু ভূমিকা ছিল। তবে ইতিহাসের অন্যান্য সময়কালে, এটি তিব্বতই প্রতিবেশীদের উপর শক্তি ও প্রভাব প্রয়োগ করেছিল এবং এই প্রতিবেশীরা চীনকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল’।
‘বিশ্বের ইতিহাসে আজ এমন কোনও দেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে তার ইতিহাসে কোনও সময় কোনও বিদেশী শক্তির দ্বারা আধিপত্য বা আধিপত্য ছিল না। তিব্বতের ক্ষেত্রে বিদেশী প্রভাব বা হস্তক্ষেপ তুলনামূলকভাবে সীমিত সময়ের জন্য ছিল’।
তবে চীন বলেছে, ‘সাত শতাধিক বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন তিব্বতের উপর সার্বভৌমত্ব রেখেছে এবং তিব্বত কখনও স্বাধীন দেশ হতে পারেনি। বিশ্বের কোন দেশ তিব্বতকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৪
আপনার মতামত জানানঃ