মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে ইয়াবা-মাদকের উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে এই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবেশি বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
কক্সবাজারের উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে গত ১ বছরে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ২৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবির কক্সবাজারস্থ ৩৪ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এসব অভিযানে ২১৬ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছেন অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো: মেহেদি হোসাইন কবির।
বিজিবির হিসেব মতে, ৫১ লাখ ৯০ হাজার ২৭ পিস ইয়াবার মূল্য ১৫৫ কোটি টাকা।
উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাসহ নিজেদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয় বলে জানান অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মেহেদি হোসাইন কবির।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) ভোরে এক অভিযানে কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন (৩৪ বিজিবি) এর অধীনস্থ পালংখালী বিওপির সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সঙ্গে চোরাকারবারিরা সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। সীমান্তে টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারিরা বিজিবির সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। বিজিবি সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছুঁড়ে। এসময় বিজিবি ২০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। একপর্যায়ে পাচারকারীরা পালিয়ে গেলে ঘটনাস্থল থেকে ১৮ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হোসাইন কবির বলেন, সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও মানব পাচার ঠেকাতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা জোরদার রেখেছে বিজিবি। তারপরও নানা কৌশলে দেশে ইয়াবা ঢুকাচ্ছে পাচারকারীরা। তবে তার চেয়ে বহু গুণ চালান পাচার প্রতিরোধ করছে বিজিবি।
বছরের পর বছর ধরে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বিশ্বের অন্যতম দুর্গম ও অনুন্নত এলাকা ছিল। কিন্তু এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন। এখানে চীনেরও ‘কৃতিত্ব’ আছে। দেশটির বহুল আলোচিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ এই অঞ্চলের মাদককারবারিদের জন্য ‘সুফল’ নিয়ে এসেছে।
অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশের স্ট্র্যাটেজিক ইন্টেলিজেন্সের সাবেক প্রধান জন কোয়েনের মতে, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন মাদক পাচারের পথ সহজ করে দিচ্ছে। এ কারণে মিয়ানমারের শান রাজ্যের দুর্গম এলাকা থেকে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে মাদক পরিবহন করা যাচ্ছে। চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ পর্যন্ত ইয়াবা ছড়িয়ে পড়েছে। এসব দেশে অহরহ ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে গত ১ বছরে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ২৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ
মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার সীমান্ত রুটে ইয়াবা ঢোকার পাশাপাশি ভারতের সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে—এমন তথ্য মিলছিল সাম্প্রতিক সময়ে। প্রশাসনের নজর এড়াতে কারবারিরা মিয়ানমার থেকে ভারত হয়ে চোরাচালান করছে বলেও দাবি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। এবার ভারত সীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করার প্রধান তিনটি রুট শনাক্ত করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এগুলো হলো, ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের কিছু এলাকা, আসামের কিছু অংশ এবং পশ্চিম বাংলার কিছু এলাকা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশে প্রায় ২৩ কোটি ইয়াবা জব্দ হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ ইয়াবাই জব্দ হয়েছে গত পাঁচ বছরে। ২০১৫ সালে জব্দ করা হয় ২ কোটি ১ লাখ ইয়াবা। ২০১৬ সালে ২ কোটি ৯৪ লাখ। ২০১৭ সালে ৪ কোটি। ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ। ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ। ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ।
ইয়াবা পাচারের যে নেটওয়ার্ক, তাতে বাংলাদেশ একই সঙ্গে ট্রানজিট ও গন্তব্য। ইয়াবা পাচার নিয়ে চিন্তন প্রতিষ্ঠান পলিসি পার্সপেকটিভস ফাউন্ডেশনের পরামর্শক বৈশালী বসু শর্মার এক বিশ্লেষণে এমনটাই বলা হয়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যেও একই তথ্য উঠে এসেছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে নয়াদিল্লিভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান পলিসি পার্সপেকটিভস ফাউন্ডেশনের পরামর্শক বৈশালী বসু শর্মা উল্লেখ করেন, ইয়াবা উৎপাদনের সর্বাধিকসংখ্যক গোপন ল্যাবরেটরি রয়েছে মিয়ানমারে।
বৈশালী বসু শর্মার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা ঢুকত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির ফলে এখন বিকল্প বা নতুন রুট দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা ঢুকছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা ঢুকছে। এ ছাড়া ভারত থেকেও বড়সংখ্যক ইয়াবা বাংলাদেশে আসছে।
সূত্র জানায়, ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের কিছু অংশ, আসামের কিছু অংশ এবং পশ্চিম বাংলার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে। মিয়ানমারের কারবারিরা প্রথমে ভারতে ইয়াবা পাচার করছে। পরবর্তী সময়ে এসব পথে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। এমন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। বেশ কিছু ফেনসিডিল কারখানা বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশের পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর দিকের সীমান্ত দিয়ে এখনো ফেনসিডিল পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া কোরেক্স, এস্কাফ, এমকে ডিল (কোডিন ফসফেট) এবং কোডোকফ নামের ফেনসিডিলের মতোই কোডিন মিশ্রিত মাদক পাচার হয়ে আসছে। প্লাস্টিক ও কাচের বোতলের পাশাপাশি পলিথিন ও ড্রামে করে আনা হয় এগুলো।
খবরে প্রকাশ, ভারতীয় সীমান্তের জিরো লাইন থেকে মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যে পাওয়া গেছে ইয়াবার কারখানা। এমন তিনটি ইয়াবা ও ২০টি ফেনসিডিল কারখানা সীমান্তের কাছে থেকে মাদক সরবরাহ করছে বাংলাদেশে।
গত ২৮ অক্টোবর ভারতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর (এনসিবি) সাথে বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) ভার্চুয়াল সম্মেলন হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে এসব কারখানার ঠিকানা, জিরো লাইন থেকে দূরত্ব, মালিকের নাম ও উৎপাদিত মাদকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়। বাকি দু’টি ইয়াবা কারখানা সীমান্তের ৪০০ মিটার ও পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে কঠোর অভিযান চালালেও মাদক থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না দেশের যুবসমাজকে। জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার কারণে ওই সব অভিযানে মাদক কারবারিদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। তার পরও এর বিস্তার রোধ করা যায়নি। বরং দেশে নতুন নতুন মাদকের দেখা মিলছে। এসব মাদক আগেরগুলোর চেয়ে আরো ভয়াবহ।
লক্ষণীয়, দেশে যতই কড়াকড়ি আরোপ করা হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ যদি মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয়, আর সেখানেই যদি গড়ে ওঠে মাদকের কারখানা; তাহলে আমাদের দেশের তরুণ-যুবকদের মাদকের হাত থেকে রক্ষার কোনো উপায় থাকে না।
তারা বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়ার পরও ইয়াবা ও ফেনসিডিল কারখানাগুলো চলতে পারে না। বরং এ ধরনের অপকর্মে যারা জড়িত; তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়াই যুক্তিযুক্ত। শাস্তি পেলে নিশ্চয় ফের মাদক উৎপাদনে সাহস পাবে না দুষ্কৃতকারীরা। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সীমান্তে মাদক উৎপাদনকারী আরো কারখানা থাকলে দ্রুত শনাক্ত করে অচিরেই যাতে সেগুলো বন্ধ করা হয়; সে জন্য ভারতের সাথে আলোচনায় বসা। দু’টি দেশ যদি একে অপরের বন্ধু হয়ে থাকে; তাহলে কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। আর একসাথে কাজ করলে মাদক নির্মূল করাও অসম্ভব কিছু নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/।কেএইচ/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ