বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা, পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে থমথমে এক বিভ্রান্তিমূলক পরিবেশ বিরাজ করছে নগরীতে। সেখানে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো মারমুখী অবস্থান নিয়ে আছে। জানা যায়, নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১০ প্লাটুন বিজিবির সদস্য এবং ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন। এ ঘটনায় দু’টি মামলা হয়েছে। প্রায় ৩০ জন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকে আসামী করে এই মামলা করা হয়, অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে শতাধিক। তবে ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে দাবি করছে আওয়ামী লীগ।
১০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ১০ প্লাটুন বিজিবি; থমথমে বরিশাল
এদিকে, বরিশাল নগরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। নগরে পুলিশ, র্যাবের টহল জোরদারের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এর মধ্যে ১০ প্লাটুন বিজিবির সদস্য বরিশালের পথে রয়েছে। রাতে তারা বরিশালে পৌঁছাবে। বিজিবির সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকবেন ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ জন্য বরিশালের বাইরের জেলা থেকে ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট চাওয়া হয়েছে। ৮ জন চলে এসেছেন। বাকিরাও আসবেন।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটির বাদী পুলিশ, অপর মামলাটি ইউএনও নিজেই করেছেন। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের আটক করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ ওরফে বাবু, ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে ফিরোজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি অলিউল্লাহ অলি প্রমুখ।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলাম বলেন, মামলায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ৩০ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
যা ঘটেছিল ইউএনও’র বাসভবনে
বরিশাল সদরের ইউএনও মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে গতকাল বুধবার রাতে হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল রাতে দুই দফায় জেলা ছাত্রলীগের কয়েকশ’ নেতা-কর্মী ইউএনওর বাসভবনে হামলা চালান বলে অভিযোগ ইউএনওর।
হামলায় ইউএনওর বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন আনসার সদস্য আহত হন। ছাত্রলীগের দাবি, এ সময় তাদের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা জানায়, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন কর্মচারী নগরের সিঅ্যান্ডবি রোডে উপজেলা পরিষদ এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার শুভেচ্ছা ব্যানার অপসারণের কাজ শুরু করেন।
এ সময় ইউএনওর কার্যালয় ও সরকারি বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা তাদের পরিচয় জানতে চান। এর পর তারআ সকালে এসে কাজ করার জন্য বলেন। এ সময় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বাকবিতন্ডা শুরু হয়।
খবর পেয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হাসান আহেমদ ওরফে বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সহসভাপতি আতিকুল্লাহ খান মুনিম, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব খান, সাজ্জাদ সেরনিয়াবাতসহ শতাধিক নেতা-কর্মী সেখানে যান। পরে সেখানে আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় নেতা-কর্মীরা ইউএনওর বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।
ইউএনও মুনিবু্র রহমান অভিযোগ করেন, ‘উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে শোক দিবস উপলক্ষে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকের ব্যানার ও পোস্টার লাগানো ছিল। রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসব ছিঁড়তে আসেন। রাতে লোকজন ঘুমাচ্ছে জানিয়ে তাদের সকালে আসতে বলা হয়। এ কারণে তারা আমাকে গালিগালাজ করে। আমার বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা চালান।’
ঘটনার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ইউএনওর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এরপর তারা পুলিশের ওপরও চড়াও হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়। করা হয় লাঠিপেটা। সংঘর্ষে আবু বকর ও শরিফুল নামের দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ইউএনওর সরকারি বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্য ফারুক হোসেন ও নাসির উদ্দিন নামের দুজন আহত হয়েছেন। তাদের সবাইকে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল বুধবার রাতের ঘটনার প্রতিবাদে আজ ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়।
বাস চলাচল বন্ধের বিষয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও মহানগর যুবলীগের সদস্য মমিন উদ্দিন বলেন, রাতে গুলিতে ও পুলিশের লাঠিপেটায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে অভ্যন্তরীণসহ দূরপাল্লার সব পথে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের উল্টো গঙ্গা
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শোক দিবসে নগরে যেসব ব্যানার, বিলবোর্ড, লাগানো হয়েছিল, সেগুলো অপসারণ করতে যান। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে ব্যানার অপসারণের কাজ শুরু করেন।
এ সময় ইউএনও তার বাসভবন থেকে নিজে বের হয়ে কর্মীদের বাধা দেন। পরে কর্মচারীরা ব্যানার অপসারণের বিষয়টি তাঁকে জানালে ইউএনও তাদের বলেন, ‘আমার কম্পাউন্ডে কোনো মেয়রগিরি চলবে না, তোমরা চলে যাও।’ পরে সেখানে থাকা কর্মচারীরা বিষয়টি মেয়রকে জানান।
এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ ওরফে বাবু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জিয়াউর রহমান ঘটনাস্থলে যান। ইউএনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও হাসান মাহমুদকে নিজের বাসভবনে আটকে রাখেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে বাসভবনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের গুলি করার নির্দেশ দেন ইউএনও। আনসার সদস্যরা নিবৃত্ত থাকলেও ইউএনও আনসার সদস্যদের হাত থেকে অস্ত্র নিজে নিয়েই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর গুলি ছোড়েন।
এ সময় সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসসহ ছয়-সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদকে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
এ সময় মেয়রের উদ্দেশেও গুলি ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। পরে শত শত নেতা-কর্মী মেয়রকে উদ্ধার করে নিরাপদে বাসায় পাঠান। সেই সময় গুলিবিদ্ধ হন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জিয়াউর রহমান, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মনির।
পরে ইউএনওর বাসভবনে আটক মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদের মুক্তির জন্য উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে সিঅ্যান্ডবি রোডে কয়েকশ’ নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হন। সে সময় আবার গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম, কর্মচারী মানিকসহ সাত-আটজন গুলিবিদ্ধ হন।
পরে হাজারো নেতা-কর্মী ও জনতা সিঅ্যান্ডবি রোডে অবস্থান নিয়ে ইউএনওর অপসারণ দাবি করে স্লোগান দিতে থাকলে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের দাঙ্গা বাহিনী সেখানে উপস্থিত হয়ে লাঠিপেটা, দলীয় নেতা-কর্মীদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এ সময় আহত নেতা–কর্মীরা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও তাণ্ডব চালায় পুলিশ। গাজী নঈমুল হোসেন দাবি করেন, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে তাদের ৬০ জন নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং ৫০ জনের বেশি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন।
আপনার মতামত জানানঃ