জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে ঘৃহহীনদের উপহার দেয়া ঘরের বয়স ১ বছর না যেতেই ভেঙে যেতে শুরু করেছে। কোথাও দেয়ালে ফাটল তো কোথাও মেঝে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কোথাও আবার দুইবার মেরামত করার দরকার পড়েছে; আবার অনেক ঘরের সামনের পিলারে ফাটল ধরেছে।
অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে বাড়িগুলোতে। এখনও চলছে জোড়াতালির কাজ। যে গৃহহীনরা থাকতো রাস্তায়, তারা এই উপহারের বাড়িতে উঠেও ভোগান্তির শিকারই হয়ে যাচ্ছে। বরং এই বাড়িগুলোতে থাকতে তারা রাস্তার চেয়ে বেশি অনিরাপদ বোধ করছেন।
ঘরে উঠতে চাইছে না গৃহহীনরা
সমস্যার কারণে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলায় মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘরে হস্তান্তরের চার-পাঁচ মাস পরেও অনেক গৃহহীন ওঠেননি।
ডামুড্যা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দুই শতক জমি ও একটি সেমিপাকা ঘর উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য আশ্রয়ন-২ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ৬৬ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৮টি ঘর নির্মাণ করে হস্তান্তর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
গৃহহীনরা উপহারের ঘরের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন
সূত্র মতে, পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের দাইমী চরভয়রা বিলের ভেতর কৃষিজমিতে ২২টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে এ ঘরগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু ওই আশ্রয়ণের ঘরে যাওয়ার কোনও রাস্তা না থাকায় উপকার ভোগীরা থাকার আগ্রহ হারিয়েছেন। নির্মাণে জড়িতরা বর্ষার স্বাভাবিক পানির উচ্চতার স্তর বিবেচনায় না নিয়ে সেখানে ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, বর্ষার পানি বাড়লে ঘরগুলো পানিতে তলিয়ে যাবে। বসবাসের উপযোগী থাকবে না। তাছাড়া ডামুড্যা উপজেলা শহর থেকে অনেক দূরে বিচ্ছিন্ন জায়গায় ঘর নির্মাণ করায় শ্রমজীবী এসব মানুষের আয়-রোজগারে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।
এ কারণেও অনেক পরিবার সেখানে ওঠেনি। ২২টি ঘরের মধ্যে মাত্র পাঁচটি ঘরে উপকারভোগীরা বসবাস করছে। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরে উঠেও নানা সমস্যার কারণে থাকতে পারেননি। আবার অনেকে এখনও ওঠেননি।
এছাড়া, চরভয়রা পূর্ব ডামুড্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ১৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ ঘরগুলো দ্বিতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন শেষে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু রাস্তার পাশে হলেও রাস্তা থেকে তিন ফুট গভীরে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায়।
একই ইউনিয়নের নওগাঁয় ১৩টি ও দারুল আমান ইউনিয়নের কাইলারা গ্রামে ১৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোও দ্বিতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন শেষে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও উপকার ভোগীরা উঠতে পারেনি।
এসব ঘর নির্মাণে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তৎকালীন ডামুড্যা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তাহমিনা আক্তার চৌধুরী।
ভুক্তভূগীদের দূর্ভোগের অভিজ্ঞতা
দাইমী চরভয়রা আশ্রয়ণের উপকারভোগী কল্পনা বেগম বলেন, ‘আমি ঘরে উঠেছিলাম। আমার ঘরের সামনের তিনটি পিলারের দুটি ফেটে গেছে। বারান্দার মেঝে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আমি স্যারদের জানিয়ে, ভয়ে চলে গেছি। এখান থেকে বের হওয়ার কোনও রাস্তা নেই। একহাঁটু কাদাপানি ডিঙিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি দিয়ে যেতে হয় রাস্তায়। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। থাকার পরিবেশ হলে ঘর মেরামত করার পরে এখানেই থাকবো।’
ভূক্তভোগী ভিক্ষুক মাজেদা বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়ে খুশি হয়েছি। সেই ঘরেই থাকি কিন্তু এখান থেকে বের হতে পারি না। ভিক্ষা ছাড়া আমার সংসার চালানোর কোনও উপায় নেই। এখন আমি বিপদে পড়েছি।’
জহুরা বেগম বলেন, ‘উদ্বোধনের পরেই আমরা ঘরে উঠেছি। কিন্তু এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। প্রচুর মশা। মানুষ থাকার পরিবেশ নেই। এলাকায় কোনও কাজ নেই। তাই এখানে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। অনেকেই ঘরে উঠছিল। সমস্যার কারণে চলে গেছে। আমাদের যাওয়ারও জায়গা নেই। ঘরটা ফেটে যাওয়ার পরে সংস্কার করে দিয়েছে স্যারেরা।’
কর্তৃপক্ষের দায় এড়িয়ে যাওয়া
এ বিষয়ে ঘর নির্মাণ কমিটির সভাপতি তৎকালীন ডামুড্যা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুর্তজা আল মুঈদ বলেন, ‘আমরা দরদ দিয়েই ঘরের নির্মাণকাজ শেষ করেছি। ফেটে গেলে তো কিছু করার নেই। পাঁচতলা বিল্ডিংও ফেটে যায়। সরকার যদি বরাদ্দ দেয় তাহলে মেরামত করে দেবো।’
সদ্য যোগদান করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ বলেন, ‘জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে আমি আশ্রয়নের ঘরগুলো পরিদর্শন করে প্রকৃত অবস্থা তাকে জানিয়েছি। ছোটখাটো কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো রিপেয়ার করার কাজ শুরু করেছি।’
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তহমিনা আক্তার চৌধুরীর সাথে গণমাধ্যম যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ