যাবজ্জীবন সাজা মানে ৩০ বছর কারাবাস বলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কোনো মামলার রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলে যাবজ্জীবন সাজা ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ বলে বিবেচিত হবে।
অর্থাৎ, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রাথমিক অর্থ ৩০ বছর কারাদণ্ড। সে ক্ষেত্রে একজন আসামি রেয়াতের সব সুবিধা পাবেন। ‘আমৃত্যু’ না থাকলে ৩০ বছর যাবজ্জীবন কারাবাস করতে হবে বলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলা হয়েছে।
তবে দেশের কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যদি রায়ে উল্লেখ করেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ আমৃত্যু কারাদণ্ড। সে ক্ষেত্রে আসামির স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাভোগ করতে হবে বলে রায় দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।
যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা বিভ্রান্তিতে ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ আমৃত্যু কারাদণ্ড, নাকি ৩০ বছর কারাদণ্ড হবে, নাকি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত আসবে, তা জানা গেল এ রায়ের মধ্য দিয়ে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান ঘটলো বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
যাবজ্জীবনের সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড নাকি ৩০ বছর, এ সংক্রান্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ সে সময়ের সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেয়।
আবেদনটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, দৃশ্যত যাবজ্জীবন মানে কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনের বাকি সময় কারাভোগ করবেন।
তবে দণ্ডবিধির ৪৫ এবং ৫৩ ধারার সঙ্গে দণ্ডবিধির ৫৫, ৫৭ ধারা ও ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫(ক) মিলিয়ে পড়লে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর বলে গণ্য হবে।
তবে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ট্রাইব্যুনাল বা আদালত কোনো আসামির আমৃত্যু কারাদণ্ড হলে দণ্ডিত আসামি কার্যবিধির ৩৫(ক) ধারার সুবিধা পাবেন না।
রায়ের পর ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের কারাদণ্ড, তবে আদালত যদি আমৃত্য সাজা দেয়, তাহলে সেটাই করতে হবে উল্লেখ করে রিভিউ রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিভাগ। তবে ৩০ বছরের এ রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মামলায় কাযর্কর না বলে আদেশন দেন আপিল বিভাগ।
আবেদনের পক্ষের খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আপিল কয়েকটি রায় যাবজ্জীবন কতদিন থাকবে, কতদিন একজন আসামির ভোগ করতে হবে, এ ব্যপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমরা সে ব্যপারে রিভিউ পিটিশন করেছিলাম এবং আমরা বলেছিলাম যাবজ্জীবন বর্তমান আইনের বিধান অনুযায়ী ৩০ বছর হবে। কারণ ৩০ বছর যদি না হয় ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫(ক)সহ আইনের অন্য বিধানগুলো এবং জেলকোড এগুলো সব বাতিল হয়ে যাবে।’
রায় আপিল বিভাগ বলেছে, যদিও যাবজ্জীবন বলতে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যতদিন, ততদিন। কিন্তু আইন অনুযায়ী একজন যাবজ্জীবন আসামির ৩০ বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আইনের অন্যান্য রেয়াত যেগুলো আছে যদি না আদালত বিশেষভাবে আদেশ দেন আমৃত্যু জেলখানায় থাকতে হবে।
যাবজ্জীবনের সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড নাকি ৩০ বছর, সে সংক্রান্ত রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৪ নভেম্বর রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর দিন ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জামান ইয়াসিনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই হত্যার ঘটনায় জামানের পিতা মো. সিরাজুল ইসলাম সাভার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, চারবাগ মাদ্রাসার সামনে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। তার লাশ ওই মাদ্রাসার তিন রাস্তার মোড়ে অলিউল্লাহর দোকানের পূর্বপাশের পাকা রাস্তার ওপর পড়েছিল।
আসামি আনোয়ার, আতাউর মৃধা ও কামরুল তাদের হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জামানকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনার তদন্ত করে ২০০২ সালের ২৭ জুলাই আদালতে ওই তিন আসামির নামে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। পরে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি আতাউর ও আনোয়ার। পলাতক থাকায় আপিল করার সুযোগ পাননি কামরুল। একই সঙ্গে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাইকোর্টে আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আপিল খারিজ করে দিয়ে তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আতাউর ও আনোয়ার। আপিলে ফাঁসির দণ্ড মওকুফ চাওয়া হয়। সোমবার (১২ জুলাই) ওই আপিলের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও মনসুরুল হক চৌধুরী এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ শুনানি করেন।
শুনানি শেষে আসামিদের আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা দেন। আদালত বলেন, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
পরে এ হত্যা মামলায় আপিল বিভাগের ৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে ‘যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাবাস’ বলে মন্তব্য করেছিলেন আপিল বিভাগ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৯
আপনার মতামত জানানঃ