‘এল ডোরাডো’, যেখানে ছড়িয়ে রয়েছে সোনার যত গুপ্ত ভাণ্ডার! কিংবদন্তি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে কতোই না উপাখ্যান আর নানা কল্পকাহিনি।
‘…ইন সার্চ অফ এল ডোরাডো’। এডগার অ্যালেন পো তার ‘এল ডোরাডো’ কবিতায় যে ছবি এঁকেছেন তা পাঠকের মনে বুনে দিয়েছে সোনায় মোড়া এক দেশকে খুঁজে দেখার অদম্য তৃষ্ণাকে। তবে যারা পড়েনওনি, কিন্তু একবার জেনে ফেলেছেন তার কথা, তাদেরও মনের ভেতরে অবধারিত ছায়া ফেলেছে এল ডোরাডো। আস্ত সোনার শহর! এমন শহর কোথায় আছে এই পৃথিবীতে? সত্যি আছে?
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এল ডোরাডোকে খুঁজে চলেছে সারা পৃথিবীর সোনালোভী মানুষ। হলুদ দুর্মূল্য ধাতুর ঝলকানি যে শহরের সর্বত্র! সেই হলদে আভায় মোড়া শহরের স্বপ্ন চোখে এঁকে দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেস্ট এবং পার্বত্য অঞ্চলে ছুটে গেছেন কত মানুষ! কিন্তু ফিরেছেন খালি হাতে।
পো তার কবিতায় লিখেছেন, ‘ওভার দ্য মাউন্টেনস/ অফ দ্য মুন,/ ডাউন দ্য ভ্যালি অফ দ্য শ্যাডো’… চাঁদের পাহাড় ও ছায়ার উপত্যকা ছুঁয়ে নাকি রয়েছে এল ডোরাডো।
তাহলে কি পৃথিবীর কোনো গোপন অঞ্চলে মাটি ও গাছের আড়ালে চিরতরে হারিয়ে গেছে এল ডোরাডো? এখনও খুঁঝে বের করতে পারলে তার চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে? মিলতে পারে সোনাও! নাকি আদৌ কখনোই ছিল না এই শহর? কিন্তু যদি নাই থাকে, তাহলে কেনই বা তৈরি হলো এই শহরকে খুঁজে বের করার প্রাণান্তকর চেষ্টা?
‘এল ডোরাডো’ শব্দটি স্প্যানিশ। যার অর্থ হলো ‘সোনায় তৈরি’। আসলে স্পেনীয়রা বলেন, ‘এল হমব্রে ডোরাডো’ বা ‘এল রেই ডোরাডো’। প্রথমটির অর্থ ‘সোনার মানুষ’। দ্বিতীয়টি বোঝায় ‘সোনার রাজা’। দক্ষিণ আমেরিকানদের কাছে এল ডোরাডো হলেন এমন এক কিংবদন্তি শাসক যার পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত মোড়া সোনায়!
গুয়াতাভিতা নামের এক হ্রদে গিয়ে শরীরে জড়ানো সোনার অলঙ্কার খুলে ভাসিয়ে দিতেন। এই লোককথাই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। সোনায় মোড়া মানুষ হয়ে ওঠে সোনার শহর! কীভাবে এই পরিবর্তন হলো?
১৬৩৮ সালে জুয়ান রডরিগেজ একটি বই লেখেন। ‘দ্য কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডিসকভারি অফ দ্য নিউ কিংডম অফ গ্রানাডা’। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছিলেন কলম্বিয়ার প্রাচীন উপজাতি ‘মুইসকা’র বিশেষ সেই প্রথার কথা। হ্রদের জলে রাজার সোনা বিসর্জনের যে প্রথার কথা আগেই বলা হয়েছে।
এই বই ও তারও আগে থেকে ছড়াতে থাকা এহেন লোককথা থেকে অন্য মানে খুঁজে বের করতে লাগলেন ইউরোপীয়রা। তাদের বদ্ধমূল ধারণা হলো সত্য়িই এককালে সোনায় মোড়া একটা শহর তার ঝলমলে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত নীল আকাশের নিচে!
হয়তো এমন ধারণা তাদের মনে খেলে গিয়েছিল, যে দেশের রাজা শরীরে জড়ানো সমস্ত সোনা অবলীলায় হ্রদের পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারেন, সেদেশের ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য না জানি কত! আর এখান থেকেই গড়ে ওঠে অলীক এক শহরের মিথ। নতুন পৃথিবীর বুকে এল ডোরাডো খুঁজে বের করার লোভে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে অগুনতি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন দুর্গম অরণ্যে।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা বলছেন, সেই সময় কলম্বিয়ায় সোনার প্রাচুর্য ছিল। তারা জানতে পেরেছেন, মুইসকা সম্প্রদায়ের কাছে আসলে সোনার কোনো গুরুত্বই ছিল না দামি ধাতু হিসেবে। কেবল দেবতার কাছে তা সমর্পণ করেই তাদের শান্তি। দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা, আজটেক ও মায়া উপজাতির মতোই মুইসকাও বিখ্যাত। আজও এই উপজাতি টিকে রয়েছে গহীন অরণ্যে। আজও এরা সোনার প্রলোভনকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়।
গুয়াতাভিতা নামের সেই রহস্যময় হ্রদটি খুঁজে বের করে সেখানে অভিযান শুরু করে ব্রিটিশ, ফরাসি ও পর্তুগিজরা। এমনও শোনা যায় হ্রদের পানি বের করে তার তলদেশে সোনা কোথায় লুকানো আছে খোঁজা শুরুও হয়। কিন্তু কোনো লাভ হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
গুঞ্জন ছিল, অনেকেই নাকি তাল তাল সোনা পেয়েছে এখানে। আসলে যেকোনো মিথেরই এইরকম দু’টি প্রান্ত থাকে। একদিনে নৈরাশ্য, অন্যদিকে প্রলোভন। গত শতকের ছয়ের দশক পর্যন্ত এমন সোনা লোভীদের দেখা মিলেছে সেখানে। ১৯৬৫ সালে রীতিমতো আইন করে কলম্বিয়া সরকার বন্ধ করে দেয় এই ধরনের অভিযান।
তবে এখনই সবাই হাল ছেড়ে দেননি। গবেষকরা মাঝে মাঝেই নানা চাঞ্চল্যকর দাবি করেন। এমনও বিশ্বাস রয়েছে, সাভানা তৃণভূমির অনেক নিচে নাকি রয়েছে সোনার শহর! মাফিয়ারা নাকি খোঁজও চালাচ্ছেন লুকিয়ে লুকিয়ে।
বলাই বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত স্রেফ গুঞ্জনই সার। হদিশ মেলেনি। আসলে এত খোঁজ, এত উত্তেজনা, এত অভিযান সত্ত্বেও আজও কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি এল ডোরাডোকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ