ডলার–সংকটের কারণ প্রসঙ্গে অর্থ পাচার প্রতিরোধ সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেছেন, ‘পাচার করা অর্থ ফেরত আনা দুরূহ কাজ। ডলার একবার চলে গেলে সহজে ফেরত আনা যায় না।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও পাচারের ১ শতাংশ অর্থ ফেরাতে পাচ্ছে। এ জন্য পাচার করা অর্থ না ফিরিয়ে কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ ফেরাতে কাজ করছে। আমাদেরও তাই করতে হবে।’
বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। নজরদারি জোরদার করার ফলে তা হচ্ছে না। এটা ঠেকানো গেছে। এখন কর ফাঁকি দিতে মূল্য কম দেখিয়ে যা আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এই তালিকায় রয়েছে গাড়ি। এদিকেও তদারকি জোরদার করা হচ্ছে।’
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামাল হোসেন বার্ষিক প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। উপস্থিত ছিলেন বিএফআইইউর উপপ্রধান নজরুল ইসলাম, পরিচালক রফিকুল ইসলাম, আরিফ হোসেনসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। তবে বিএফআইইউ গতকাল বলেছে, জিএফআইয়ের তথ্য পুরোটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিএফআইইউর কাজের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার কাজের স্বাধীনতা শতভাগ। তবে জনবলের স্বল্পতা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ৫০-৬০ শতাংশ জনবল নিয়ে চলছে। আমাদের অনুসন্ধানে যা বের হয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। এ জন্য আমাদের কাজের সফলতার জন্য তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত যায়। তাদের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে।’
বিএফআইইউ বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করে আইনি ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠায়।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমা প্রসঙ্গে বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, সুইজারল্যান্ডের ২৫০টি ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে সব দেশে জমা হওয়া অর্থই সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে আসছে।
বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা এসব ব্যাংকে অর্থ রাখছেন। আর সুইস ব্যাংকে যে অর্থ জমার কথা বলা হচ্ছে, তার মাত্র ৩ শতাংশ ব্যক্তির। যার পরিমাণ ২৪২ কোটি টাকা। বাকি টাকা অন্য ব্যাংকের দায়, অসমন্বিত থাকা হিসাব। গণমাধ্যমে শুধু সুইস ব্যাংকের জমা হওয়া অর্থের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, সেই ব্যাংকে আমাদের যে দায় আছে, তা প্রকাশ হচ্ছে না।
সুইজারল্যান্ড আইন পরিবর্তন করেছে, আগামী বছর থেকে কারা অর্থ রেখেছে, তার তথ্য পাওয়া যাবে। এ জন্য ব্যক্তির নাম, অভিযোগের বিষয়বস্তু এবং ওই দেশের ব্যাংকের নাম পাঠাতে হবে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
ডলার–সংকটের অন্যতম কারণ অর্থ পাচার, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, আমদানি কমে আসছে। সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বছরে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতি বছর দেশের এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে।
আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার মনিটরিং সংস্থা- বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিআইএফইউর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন।
আর গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি বলছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ।
উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সাড়ে ১৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সংস্থাটির।
বিদেশে টাকা পাচার রোধ, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আর পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে একযোগে কাজ করছে রাষ্ট্রের ৮টি সংস্থা। তবুও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না পাচার? কিংবা ফেরত আনা যাচ্ছে না দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ?
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কৌঁসুলি খুরশিদ আলম বলেন, সংসদ সদস্য, বড় ব্যাংকার থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের কারণে এই অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, কাগজে কলমে ব্যাংকিং খাত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি আছে। কিন্তু সেই নজরদারি যথেষ্টভাবে সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করছে না।
খুরশিদ আলম বলেন, টাকা পাচারের মাধ্যমে পুরো দেশকে আর্থিকভাবে অচল করে দেওয়া হচ্ছে, পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। যারা টাকা পাচার করছে তাদের কয়েকজনকে যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে সবাই টাকা পাচার করতে ভয় পাবে।
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার তথ্য প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশ থেকে পাচার হওয়া লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১২১৮
আপনার মতামত জানানঃ