জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে বিশ্বের বড় ছয়টি নদী। অপ্রতুল বৃষ্টি এবং টানা তাপপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নদীগুলো ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদ-নদী আবার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রতিনিয়তই নদীর তলদেশ পানির ওপর থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিছু নদী এতই শুকিয়ে গেছে যে সেগুলো কার্যত চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
জলবায়ু সংকট বৈশ্বিক আবহাওয়াকে দিন দিন বৈরী করে তুলেছে। এ কারণে শুধু নদ-নদীই নয়, এগুলোর ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশ্বের প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল—এটি হতে পারে খাওয়ার পানি, কৃষিকাজে কিংবা জ্বালানি উৎপাদনে অথবা পণ্য পরিবহনে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনজীবন।
কলোরাডো নদী
যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে খরার মতো পরিবেশ বিপর্যয়। ভবিষ্যতে এ খরা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। খরায় কলোরাডো নদী আশঙ্কাজনকভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বৃহত্তম জলাধার দ্বারা নদীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। নদী অববাহিকাকে রক্ষা করতে সরকার বাধ্যতামূলক পানির ব্যবহার কমানো কার্যকর করেছে এবং অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোকে করণীয় পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে বলেছে।
সেই জলাধারগুলোর একটি মিড হ্রদ। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হ্রদের আকার সংকুচিত হচ্ছে। হ্রদের পানির স্তর ২০০০ সাল থেকে কমতে শুরু করেছে। তবে ২০২০ সাল থেকে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রদের পানি কমতে শুরু করে।
গত বছর হ্রদের পানি এতটাই নিচে নেমে যায় যে এর তলদেশ থেকে বন্য প্রাণীর ফসিল আবিষ্কার করা হয়, যার মধ্যে একটি চোঙায় থাকা মানবদেহাবশেষও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক দশক আগে হত্যার পর তাকে হ্রদে ফেলে দেওয়া হয়। কলোরাডো নদী সংকটের পরিণতি ব্যাপক—যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গরাজ্য ও মেক্সিকোর প্রায় চার কোটি মানুষ পানীয়, কৃষি ও বিদ্যুতের জন্য এ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
ইয়াংজি নদী
এশিয়ার অন্যতম নদী চীনের ইয়াংজি খুব দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। ইয়াংজির উপনদীগুলো ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। সম্প্রতি চীন গত নয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী খরার সতর্কতা ঘোষণা করেছে এবং দেশটির তাপপ্রবাহ ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলেছে।
ইয়াংজি নদী শুকানোয় এর আশপাশের অঞ্চলগুলোয় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। চীনের সিচুয়ানে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষের বাস। এখানকার জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষমতার প্রায় ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এর বেশির ভাগই ইয়াংজি নদী থেকে আসে। সম্প্রতি এ নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমে গেছে, যার কারণে সেখানকার কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলোকে ছয় দিন উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলতে বাধ্য হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই প্রদেশে এ বছর স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে বেশ কয়েকটি জলাধার পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে।
রাইন নদী
রাইন সুইস পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়ে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মধ্য দিয়ে উত্তর সাগরে পড়া একটি নদী। জার্মানির এ নদী ইউরোপীয় অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল।
কিন্তু বর্তমানে এ পথে জাহাজ চালানো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। রাইন নদীর তলদেশ ভেসে উঠেছে। এ কারণে এই পথে চলাচল করা সব জাহাজকে অনেক বাধা পার হতে হয় এখন, যা পুরো পণ্য পরিবহনের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিয়েছে।
রাইনের পথে অনেক পরিমাপক রয়েছে, যার একটি জার্মানির ঠিক পশ্চিমে ফ্রাঙ্কফুর্টের কাউব, যেখানে পানির স্তর ৩২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। শিপিং কোম্পানিগুলো সাধারণত রাইন নদীর কোনো জায়গায় ৪০ সেন্টিমিটারের কম পানিকে চিন্তার কারণ হিসেবে মনে করে।
দেশটির অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত ৭৫ সেন্টিমিটারের কম মানে একটি কনটেইনার জাহাজের লোড প্রায় ৩০ শতাংশ কমাতে হয়। নদীতে পানির স্তর কমে যাওয়ার অর্থ হলো কোম্পানিগুলোকে এ পথ অতিক্রমের জন্য বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। এসব কারণে পণ্য পরিবহন আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে, যার বোঝা সরাসরি সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চলে যায়।
পো নদী
পো নদীটির উৎপত্তিস্থল ইতালি, যা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে গিয়ে পড়েছে। শীতে পর্বতের চূড়ায় এর পানি জমে বরফ হয়ে যায় এবং বসন্তে ভারী বৃষ্টিপাতে প্রবল স্রোত সৃষ্টি হয়। এ নদীর একটি সমস্যা হচ্ছে, এর কারণে এর আশপাশের এলাকা প্রায়ই প্লাবিত হয়। সৃষ্টি হয় বিধ্বংসী বন্যা।
কিন্তু এখন পো নদীর রূপ পাল্টে গেছে। ইতালির উত্তরাঞ্চলে শীতকাল শুষ্ক ছিল। সে কারণে বরফ গলে পো নদীতে পানির সরবরাহ হয়েছিল। সেখানকার বসন্ত ও গ্রীষ্মও শুষ্ক ছিল। এ অঞ্চলে সাত দশক ধরে সবচেয়ে খারাপ খরায় নিমজ্জিত হয়েছে। এটি এতটাই শুকিয়ে গেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি বোমা সম্প্রতি পো নদীর তলদেশে পাওয়া গেছে।
একটি বড় সমস্যা হলো, লক্ষাধিক মানুষ জীবিকার জন্য পো নদীর ওপর নির্ভরশীল। এ নদীর ওপর কৃষিকাজ অনেকটাই নির্ভর করে। ইতালির প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্য পো নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় উৎপাদিত হয় এবং দেশটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রপ্তানিপণ্য পারমেসান পনির ওই এলাকাতেই তৈরি হয়।
লয়ার নদী
নদীটি প্রায় ৬০০ মাইলজুড়ে বিস্তৃত এবং ফ্রান্সের শেষ নদী, যেটি বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সমগ্র উপত্যকায় জীববৈচিত্র্য–বাস্তুতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে। নদীর কিছু অংশ ইতিমধ্যেই মোটামুটি অগভীর।
তবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে এবং এর উৎসের বরফ গলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর স্তর ও প্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। কিছু অংশ বৃষ্টির অভাবে ও প্রচণ্ড গরমে এতটাই শুকিয়ে গেছে যে মানুষ হেঁটে নদী পাড়ি দিতে পারে।
দানিয়ুব নদী
দানিয়ুব হাঙ্গেরির নদী। এটি পশ্চিম ইউরোপের দীর্ঘতম নদী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং চ্যানেল, যা ১০টি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রোমানিয়া, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ায় শ্রমিকেরা নদীটি ড্রেজিং করছেন, যাতে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখনো এটিতে চলাচল করতে পারে।
ইউরোপের অন্যান্য নদীর তুলনায় এ নদীর অবস্থা খানিকটা ভালো। তবে হাঙ্গেরির মতো দেশগুলো পর্যটনের জন্য দানিয়ুবের ওপর এতই নির্ভরশীল যে এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।
নদীর পানি কমে যাওয়ায় কিছু পর্যটকবাহী জাহাজ হাঙ্গেরিতে পৌঁছাতে নদীর কিছু অংশ অতিক্রম করতে পারছে না। হাঙ্গেরির পর্যটন বোর্ডের তথ্যমতে, ১ হাজার ৬০০ টনের একটি জাহাজ এখন কোনো পণ্য পরিবহন না করে কেবল হাঙ্গেরিতে ঢুকতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৮
আপনার মতামত জানানঃ