প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে শহরটি। ফলে বিশ্বমানের পর্যটকবান্ধব নগরী না হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে শহরটি। দিনদিন নানাবিধ নাগরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। সমুদ্রের জীববৈচিত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাৎসরিক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হলেও পর্যটন নগরীকে ঘিরে আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়নি। নেই কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। গড়ে তোলা হয়নি সুয়ারেজ সিস্টেম। পয়োবর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ; ভাঙাচোরা সড়কে নাজুক নগর জীবন।
এদিকে, পর্যটক ছাড়াও দেশি-বিদেশি শতাধিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা অস্থায়ীভাবে বাস করেন এই শহরে। তাই কক্সবাজার অনেকটা ‘ফেস অব বাংলাদেশ’।
অপরিকল্পিত নগরায়ন আর আবর্জনার শহর
গত এক যুগে কক্সবাজারের পর্যটন খাতের অধিকাংশ সম্প্রসারণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি পরিবেশ রক্ষা নীতিমালা। যেখানে সেখানে স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেক হোটেল নির্মাণ হলেও রাস্তার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
পরিকল্পিত নগরায়ন না হওয়ায় ইতোমধ্যে কক্সবাজারের প্রধান সড়কের সম্প্রসারণ নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কারণ সড়কের দুই পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক পুরোনা স্থাপনা রয়েছে।
পৌর এলাকার হলি ডে মোড় থেকে শুরু করে দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ সীমান্ত পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশো হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ ও কটেজ গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে ৬টি তারকা হোটেলসহ ২৪টি বড় হোটেল রয়েছে। এছাড়া আড়াই শতাধিক রেস্তোরাঁও আছে এখানে। তবে এসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে।
২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত এক রুলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপরও সংরক্ষিত এলাকায় নির্মাণ কাজ হয়েছে। এসব এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক জমি রয়েছে। এসবের কোন সুরাহাও হয়নি। আর স্থাপনাগুলো উচ্ছেদেরও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
গড়ে ওঠেনি কেন্দ্রীয় সুয়ারেজ সিস্টেম। হোটেল-মোটেলগুলোর নিজস্ব সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও নেই। দুই লাখ বাসিন্দা ছাড়াও বছরে কোটি পর্যটকের আগমন ঘটে এই পর্যটন নগরীতে। পুরো পৌর এলাকা থেকে দিনে প্রায় ১৪৫ কোটি টন পয়োবর্জ্যের সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে মাত্র ২০ টন সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে পৌর প্রশাসনের। নালার মাধ্যমে বাকী বর্জ্যের শেষ গন্তব্য হয় নদী ও সাগরে; ফলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
কক্সবাজার সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা সুগন্ধা পয়েন্টের সৈকতে নামলে আবর্জনার স্তুপ জমে থাকতে দেখা যায়। শুধু সুগন্ধা পয়েন্ট নয়, পাঁচ তারকা হোটেল কক্স টুডের সামনে-পেছনেও পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। বন বিভাগের বাংলো কল্লোলের সামনে নালায় ময়লা পানি ও আবর্জনা জমে আছে। বাংলোর পেছনে উর্মি পয়েন্টেও আবর্জনার স্তুপ রয়েছে। এসব আবর্জনা মাড়িয়ে সৈকতে নামতে হয় পর্যটকদের।
এছাড়া কলাতলী থেকে হলি-ডে মোড় পর্যন্ত হোটেল-মোটেল এলাকার দীর্ঘ এ সড়কের দুই পাশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। এসব আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন এলাকার সৈকতেও। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। হচ্ছে পরিবেশ দূষণও।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শ্রী বিশ্রী
স্বাভাবিক সময়ে পর্যটনকে ঘিরে কক্সবাজারে বছরে কয়েক কোটি মানুষের আগমন ঘটে। এছাড়া পৌর এলাকায় রয়েছে দুই লাখের বেশি স্থায়ী বাসিন্দা। পর্যটন মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন ১৪০-১৫০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। স্বাভাবিক সময়ে এর পরিমাণ ১২০-১৩০ টন হয়।
কক্সবাজারের পর্যটন এলাকা ছাড়াও শহরের প্রধান সড়কের বিজিবি ক্যাম্প এলাকা থেকে লালদীঘি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ডাস্টবিনে বিকাল পর্যন্ত আবর্জনা পড়ে থাকে। কুকুর-গরুর বিচরণে এসব আবর্জনা ছড়িয়ে যায় সড়কের ওপরেও। শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন উপসড়কে আবর্জনার স্তুপ দেখা গেছে। নির্ধারিত সময়ে আবর্জনা সংগ্রহ না করায় তা নালা-নর্দমায় পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
শহরের বর্জ্যগুলো প্রতিদিন সকাল ৮টার আগে পৌর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া কথা। তবে অভিযোগ আছে, তারা নির্ধারিত দায়িত্ব না পালনের কারণে ময়লা-আবর্জনায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে পর্যটন এলাকায়। পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৫০০ পরিচ্ছন্ন কর্মী।
কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার অস্থায়ী ডাস্টবিন থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে ফেলা হচ্ছে বাঁকখালী নদীর তীরে। গত কয়েক বছর ধরে ফেলা আবর্জনায় ইতোমধ্যে নদীর তীরের প্রায় পাঁচ একর জমি ভরাট হয়ে টিলা আকৃতি হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানিতে ধুয়ে এই বর্জ্য বাঁকখালী নদী হয়ে সাগরে মিশে যায়। নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে।
কক্সবাজারকে পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা ছিল পৌর মেয়রের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধান প্রতিশ্রুতি। কিন্তু চার বছরেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
একসময় কক্সবাজার শহরের অভ্যন্তরে ৪৩টি ছোট-বড় নালা ও ছড়া ছিল। বর্তমানে এর বেশিরভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। ছোট নালা-নর্দমাগুলোও ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় হোটেল-মোটেল জোন এবং প্রধান সড়কের আশপাশের এলাকায়।
নালা-নর্দমায় নোংরা পানি জমে থাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে। তবে নতুন করে সড়ক সংস্কারে সড়কের পাশে ড্রেন নির্মাণ করছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)।
সড়কের রুগ্ন দশা
কক্সবাজার শহরের কলাতলী হোটলে-মোটেল জোন সড়ক ছাড়া প্রায় সব সড়ক-উপসড়কের রুগ্ন দশা। শহরের লাবনী পয়েন্ট থেকে ভাঙাচোরা সড়কের শুরু। প্রধান সড়ক থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত খানাখন্দে ভরা রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী। খানাখন্দে নোংরা পানি ও আবর্জনা জমে একাকার।
কোথা কোথাও কাদা-মাটির কারণে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে পায়ে হেঁটে চলাও কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে পুরো অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যহত হচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘শহরের পশ্চিম বাজারঘাটার বাসিন্দা আমি। বাসা থেকে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কোরাল রিফ প্লাজার দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে স্বাভাবিক সময়ে মাত্র ১০ মিনিট সময় লাগতো। কিন্তু সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে এখন আমাকে বাস টার্মিনাল-কলাতলী-লাবনী পয়েন্ট দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে হয়। এখানে ব্যবসায়ীরা খুব বিপদে আছেন। রাস্তাঘাটের কারণে মানুষ এখানে আসতে চায় না।’
এইসব সড়কে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশার চালক নুরুল আমিন বলেন, ‘ভাঙা সড়কে সবসময় যানজট লেগে থাকে। অনেক সময় নষ্ট হয়। এ সড়কে চলাচলের কারণে গাড়ি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বারবার মেরামত করতে হয়।’
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবছর পর্যটনকে ঘিরে কয়েক কোটি মানুষের আগমন ঘটে কক্সবাজারে। কিন্তু গেল ৫০ বছরেও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি কক্সবাজারকে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সড়কের দুরবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। কিন্তু এরপরেও কোনো সুফল মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১২
আপনার মতামত জানানঃ