এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে ২ মিটার এবং ২১৫০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াতে পারে ৫ মিটার পর্যন্ত। আমরা যদি ২১০০ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্য আটকেও রাখি, তবুও ধীরে ধীরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে এবং এর মারাত্মক প্রভাবগুলো আমরা এড়াতে পারবো না। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই শতাব্দীতেই ভারতের ১২টি শহর প্রায় তিন ফুট পানির তলায় চলে যাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে নাসা।
পানির নিচে তলিয়ে যাবে ভারত
‘জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, এটি বর্তমান। যা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলকেই এখন প্রভাবিত করছে’ বলে মন্তব্য করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা আইপিসিসি’র প্রতিবেদক ড. ফ্রেড্রিক অটো। এবার একই সুরে সতর্ক করল নাসাও।
এই শতকের শেষে মুম্বই, চেন্নাই, কোচি সহ ভারতের ১২টি শহর প্রায় তিন ফুট পানির তলায় চলে যাবে বলে রিপোর্ট দিয়েছে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। নাসা এই রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে যে জানিয়েছে, তা ভারতের পক্ষে রীতিমতো চিন্তার কারণ। নাসার মতে, দেশের ১২টি উপকূলীয় শহর ও বন্দর এক থেকে তিন ফুট পানির তলায় চলে যাবে। এই শহরগুলির মধ্যে আছে বাণিজ্য রাজধানী মুম্বই, দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রধান শহর চেন্নাই। তাছাড়া কেরালার কোচি, অন্ধ্রের বিশাখপত্তনম এবং পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুর এই তালিকায় আছে।
প্রতিবেদনে শহরগুলোর কোনটি কত ফুট পানি নিচে তলিয়ে যাবে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে কোচিন ২.৩২ ফুট, মুম্বাই ১.৯০ ফুট, বিশাখাপত্তম ১.৭৭ ফুট, চেন্নাই ১.৮৭ ফুট, কান্দলা ১.৮৭ ফুট, ওখা ১.৯৬ ফুট, ম্যাঙ্গালোর ১.৮৭ ফুট, ভৌনগর ২.৭০ ফুট, ও তুতিকোরিন ১.৯ ফুট, মরমুগাও ২.০৬ ফুট, পরাদ্বীপ ১.৯৩ ফুট এবং খিদিরপুর ০.৪৯ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।
বিশ্বে পরিবেশ দূষণ, উষ্ণায়ন সহ বিভিন্ন কারণে সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। এশিয়ায় জলস্তর বৃদ্ধির পরিমাণ অন্য জায়গার তুলনায় বেশি। আইপিসিসি-র মতে, আগে একশ বছরে যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০-এর মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা হবে। এই শতাব্দী জুড়ে উপকূলে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানির তলায় চলে যাবে।
আইপিসিসি রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আঞ্চলিক স্তরেও নানা পরিবর্তন হতে পারে। বৃষ্টি বেশি হবে, আবার কোথাও বৃষ্টি হবে না। খরা দেখা দেবে। কোথাও প্রচুর বরফ পড়তে পারে।
২০০৬-১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলস্তর নিয়ে যে সমীক্ষা করা হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে, গোটা বিশ্বে প্রতি বছর জলস্তরের গড় বৃদ্ধি হয়েছে ৩.৭ মিলিমিটার। ফলে এখন থেকেই সতর্ক হয়ে পরিবর্তন রোধ করার চেষ্টা না করলে ভবিষ্যৎ ভয়ংকর হতে বাধ্য। কারণ, পরিবর্তন রোধ করার কাজ রাতারাতি হয় না। তাতে অনেক সময় লাগে।
প্রতিকারের উপায়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা আন্টার্কটিকায় থেকেই সব চেয়ে ভাল বোঝা যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে অ্যান্টার্কটিকায় তাপমাত্রা ছিল রেকর্ড ১৮ ডিগ্রি। সে সময় ভারতের মিশনে সেখানে ছিলেন পরিবেশবিজ্ঞানী পুনর্বসু চৌধুরী। সম্প্রতিই দেশে ফিরেছেন তিনি।
ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ”জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নানারকম আলোচনা হয়। প্যারিস কনভেনশন থেকে শুরু করে নানা জায়গায় বহু সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু পরিবেশকে তখনই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, যখন ব্যক্তিপর্যায়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে। আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রায় কার্বন নিঃসরণের হার কমানো অসম্ভব।”
তার মতে, ”গাড়ি, এসি সহ বিভিন্ন জিনিসের ব্যবহার বা অভ্যাস বদল না করলে শুধু জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো যাবে না।”
পরিস্থিতি কতটা খারাপ তা বোঝাতে একটা উদাহরণ যথেষ্ট। শিল্পবিপ্লবের সময় কার্বন নিঃসরণের যে পরিমাণ ছিল, এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে মানুষকে বাঁচতে গেলে, বিশ্বকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি ব্যক্তিকে উদ্যোগী হতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন পুনর্বসু।
দীর্ঘদিন দেশটির সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকা পরিকল্পনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমিতাভ রায়ের মতে, ”আমরা প্রায়ই শপথ নিই যে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ফেলব, বাস্তবে তা হয় না। খাতায়-কলমে অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়, আমরা অনেক প্রতিজ্ঞা করি, অনেক চুক্তিতে সই করি, বাস্তবে তার প্রয়োগ করা হয় না বলেই আইপিসিসি যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা সত্যি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
অমিতাভ জানিয়েছেন, ”এর আগে জাতিসংঘ সব দেশের জন্য মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বেঁধে দিয়েছিল। ২০০০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হতো। তাতে ১৫ দফা বিষয় ঠিক করা হয়ছিল। ২০১৫ সালে মূল্যায়নের সময় দেখা গেল, তার রূপায়ণ হয়নি।”
অমিতাভ বলছেন, ”এরপর ২০১৫ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ঠিক করলো জাতিসংঘ। সেটাও পূরণ হবে এমন আশা কম। তখন হয়তো আবার ১৫ বছরর জন্য অন্য নামে কোনো লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করা হবে। জলবায়ু পরিবর্ত রোধ করার কাজটাও এভাবেই হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবিলম্বে ব্যক্তি থেকে সরকার প্রতিটি পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে মানুষের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আধুনিক জীবনযাত্রা অনুসারে চলতে গিয়ে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানের সূত্র মেনে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পানির আয়তনও বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া মেরু অঞ্চল ও পর্বতচূড়ায় অবস্থিত বরফ গলে যাওয়ার ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ থেকে ৩৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম আন্টার্কটিকায় বড়সড় কোনো ভাঙন দেখা দিলে এটা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ